শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

৭ খুনের রায়ের পর অনেক কিছু খোলাসা হচ্ছে

[দুই]

জিবলু রহমান : চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার পর নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদ চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, ছয় কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে সাতজনকে অপহরণ ও খুন করা হয়েছে। অবশ্য কখন ও কোথায় এ টাকা লেনদেন হয় সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি তিনি। 

চূড়ান্তভাবে বিদেশে পাচারের আগে রিয়া কয়েক দফা টাকাগুলো গুলশান এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তিনি তার ভাবী হেমার কাছে টাকাগুলো জমা রাখেন। যথাযথভাবে সেই আমানত গচ্ছিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন হেমা।

ফোনালাপের সময় সাবধানতার অংশ হিসেবে তারা দু’জনে অনেকটা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। যেমন এক কোটি ষাট লাখ টাকাকে তারা বলেন, ‘এক ষাট’। পঞ্চাশ লাখ টাকাকে বলেন, ‘পঞ্চাশ টাকা’। তাদের দু’জনের ফোনালাপ ছিল অনেকটা এরকম-

রিয়া : হ্যালো?

হেমা : জি আপা।

রিয়া : রনি ফোন ধরে না কেন? বেহুদা?

হেমা : রনি জরুরি মিটিংয়ে আছে রিয়া আপু। আমারও ফোন ধরেনি। আজকে দুনিয়ার লোকজন নিয়া বসছে। ইঞ্জিনিয়ার-টিঞ্জিনিয়ার আসছে। আদৌ কয়টায় আসে। আই ডোন্ট নো।

রিয়া : আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যদি এখন তোমাকে এক ষাট (এক কোটি ষাট লাখ টাকা) রাইখা দিতে বলি তবে রাইখা দিতে পারবা?

হেমা : বাসায় আপাতত পারবো, কালকে ওইখানে সরাবো।

রিয়া : সেটা আমি জানি না, তোমার তারেক ভাইয়ের আমানত। এখন তোমার কাছে দিয়া দিতাছি।

হেমা : পারব আপা, পারব। এটা কোনো ব্যাপার না।

রিয়া : তাইলে আমি তোমার কাছে দিয়া দিতাছি।

হেমা : কিন্তু তুমি শুক্র-শনিবারে টাকা নেয়ার কথা বলবা না। কারণ এটা আমার লকারে থাকবে।

রিয়া : আরে না না। আমি শুক্র-শনিবারে নিয়া কী করব। এটা তো রনির কাছেই যাবে। এটা ধরে নাও যে, তোমার ভাইয়ের আমানত তোমার কাছে। আমি এটা আমার কাছে রাখব না। এখন আমি কি তোমার বাসায় (টাকা নিয়ে) আসব?

হেমা : আসো, আসো।

এভাবে এক দফা এক কোটি ষাট লাখ টাকা সরিয়ে নেয়ার পর আরেক দফায় ৫০ লাখ টাকা সরানো হয়। সে সময়ের কথোপকথন ছিল অনেকটা এরকম-

রিয়া : একটা পঞ্চাশ টাকা রাইখা যাইতে হবে তোমার কাছে।

হেমা : আচ্ছা রাইখা যান। সমস্যা নাই।

রিয়া : কার কাছে দিয়ে যাব?

হেমা : আম্মুর কাছে রেখে যাও। আম্মু না থাকলে সুলতানার কাছে (তারেকের নিকটাত্মীয়) রেখে যাও।

রিয়া : আমি ৯টা-সাড়ে ৯টা বা ১০টায় মুভ করব।

হেমা : যখনই হোক, সুলতানার কাছে রেখে গেলেই হবে।

রিয়া : তাহলে তোমার কাছে আগে এক ষাট, আজকে দিলাম হল চল্লিশ। মোট দুই। আর এখন দিমু পঞ্চাশ। তাহলে দুই পঞ্চাশ।

হেমা : হ্যাঁ, সেটাই।

এভাবে দু’দফা আড়াই কোটি টাকা সরানোর কয়েকদিন পরপরই আরও এক কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা সরানোর প্রস্তুতি চলে। এ সময় গোয়েন্দাদের হাতে আসা তাদের ফোনালাপ ছিল নিম্নরূপ-

রিয়া : হেমা শোনো, মনিররে (ড্রাইভার) বা জসিমকে (আরেক ড্রাইভার) একটু পাঠাইবা।

হেমা : কোনো সমস্যা নাই সুইটহার্ট। জসিম আসুক তারপরে তোমার ওখানে পাঠাইয়া দিতাছি।

রিয়া : আরও এক পঞ্চাশ তোমারে দিয়ে দিতেছি। তাহলে সব মিল্লা কত হল বলো?

হেমা : প্রথমে দিলা এক-ছয়। তারপরে দিলা চল্লিশ। দুইটা মিল্লা মোট হইলো দুই। পরে দিছিলা পঞ্চাশ। এখন দিতাছো এক পঞ্চাশ। তাইলে মোট হইলো চার (চার কোটি)। এছাড়া আলাদা কইরা ত্রিশ হাজার দিছিলা। ওইটার সাথে তো এটার কোনো হিসাব নাই।

রিয়া : না না এটা তো তোমার তারেক ভাইয়ের জিনিস। এটার সাথে ত্রিশ হাজারের কোনো মিল নাই।

এভাবে রিয়া কয়েক দফা তারেক সাঈদের মোট চার কোটি টাকা তার আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান। এরপর রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারেকের ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। সেখানে একটি ব্যাংকে টাকাগুলো জমা রাখা হয়। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ২৩ জানুয়ারি ২০১৭)

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘র‍্যাবের পদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত হওয়া সত্ত্বেও সাত খুনের বিচারে যে হস্তক্ষেপ করা হয়নি, সেটি একটি স্বস্তির বিষয়। এখন কবে এই রায় কার্যকর হবে, তার অপেক্ষা করব।’ তাঁর মতে, র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার যে অভিযোগ রয়েছে, তার কিন্তু বিচার হয়নি। সুতরাং সাত খুনের বিচার হওয়ার কারণে সেসব অভিযোগকে অবজ্ঞা বা লঘু করে দেখা সমীচীন নয়। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ২৪ জানুয়ারি ২০১৭)

সাত খুন মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পেতে পারেন। এ ধরনের নির্মম ও নৃশংস হত্যার বিচার হলে অপরাধীরা কিছুটা হলেও খামোশ হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কমবে। বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার রায়ের পর ২০১৩ সালে সংঘটিত তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিটিও সামনে এসেছে। সরকার কোনো মামলায় ‘বিবেকের’ দায়িত্ব পালন করবে, আর কোনো কোনো মামলায় নির্বিকার থাকবে, সেটি হতে পারে না।

গত এক বছরে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে কয়েকটি খুন অথবা খুনের প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটে গেল। দেশী এবং বিদেশী নাগরিকরা খুন হয়েছেন। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় যেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকার কথা সেখানেই খুন হলেন জনৈক নিরীহ ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার। তারপরই প্রায় একই কায়দায় রংপুরের গ্রামে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হয়েছেন জনৈক জাপানি কৃষি গবেষক, আরেকজন নিরীহ বিদেশী নাগরিক হোশি কোনিও। এর কিছু দিন পরই খবর এলো পাবনার ঈশ্বরদীতে জনৈক বাঙালি খ্রিস্টান পাদ্রি লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যা করার চেষ্টা নিয়েছিল কয়েকজন দুর্বৃত্ত। বিরোধী দলের লোকদের গ্রেফতার করতে পুলিশ যেখানে তৎপর, এমনকি ‘হুকুমের আসামী’ (?) কে, তাও নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারছে, সেখানে পুলিশের এ গাফিলতি ও ব্যর্থতা বড় বেদনাদায়ক।

আলোচিত সাত খুনের পেছনে বালুমহাল ও ব্যবসা দখলের কোন্দল ছিল৷ গুমের থাবা থেকে ফিরে আসা আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের পেছনেও ভূমিগ্রাসীরা জড়িত বলে অভিযোগ৷ নরসিংদীর পৌর চেয়ারম্যান লোকমান বা নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর হত্যার পেছনেও ছিল ক্ষমতার রেষারেষি৷ প্রকাশ্য খুন আর গুম-খুন মিলিয়ে তাহলে পাচ্ছি দুটি কারণ-ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা বিত্তের বাসনা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তথা অবৈধ ক্ষমতার অভিলাষ৷

সরকারবিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের অজস্র মামলার বিপরীতে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতা-কর্মীদের নামে যেসব মামলা ছিল সেগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে দায়েরকৃত মামলাসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দায়ের হওয়া খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি-আত্মসাৎ, মাদকব্যবসা ও ডাকাতিসহ গুরুতর অপরাধে দায়ের করা মামলাও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়। 

এ দেশে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদবে? দেশে বিচার যে নেই তা নয়, অনেক মামলার বিচার হচ্ছে। ক্ষমতাবানের ক্ষমতা কত দূর হতে পারে তার দৃষ্টান্ত কিছু কিছু মানুষ আগেও পেয়েছে। কিন্তু মানুষের চোখে দেখা তথ্যকে এবং বিশ্বাসকে এভাবে দলে থেঁতলে দেওয়ার নমুনা আর দ্বিতীয়টি নেই।

মহাজোট সরকারের আমলে এই মামলা প্রত্যাহার অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মামলা প্রত্যাহারের এই হিড়িকে পুলিশ হত্যাকান্ডের মতো চাঞ্চল্যকর অপরাধের মামলাও তুলে নেয়া হয়েছে। চার্জশিট দাখিল, জজকোর্টে চলমান-এমনকি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলা থেকেও ব্যক্তি বিশেষকে রেহাই দেয়া হয় সরকারের এই প্রক্রিয়ার আওতায়। প্রত্যাহার করে নেয়া মামলার মধ্যে ৫ হাজারের বেশি মামলা ফৌজদারী অপরাধের। 

ঢালাওভাবে মামলা প্রত্যাহার ও খালাস পেয়ে কোন কোন আসামী ফের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে, লিপ্ত হচ্ছে খুনখারাবিতে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া লগি-বৈঠার মামলা (পল্টন হত্যাকান্ড) প্রত্যাহার করে নেয়া হয় কমিটির প্রথম বৈঠকে। 

সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়ে তাদের দায়মুক্ত করতে বসে নেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং আমলাদের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্বতের মুষিক প্রসব ঘটে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগই দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ, অনেকটা গোপনেই মামলা নথিভুক্ত করে দায়মুক্তির ‘সনদ’ দিচ্ছে কমিশন। 

দৈনিক সংগ্রাম ২০ নবেম্বর ২০১৪ সংখ্যার তথ্যে জানা যায়, গত তিন বছর আট মাসে কমিশন বিলুপ্ত ব্যুরোসহ ৫৩৪৯টি দুর্নীতির অনুসন্ধান নথিভুক্ত করে আসামীদের দায়মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৪ সালে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬শ’ রাজনীতিক ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এই আট মাসে ৯০৪টি দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ৮৭০জনের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের হয়নি। এছাড়া, ৩০৭টি মামলায় ৭১৮জন আসামীর বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ায়’ তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত পদ্মাসেতু দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ১০জনকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হককেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার কথা জানায় দুদক। এছাড়া, আট মাসে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন, জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাবেক এমপি এইচবিএম ইকবাল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন নেসা, পেট্রোবাংলার জিএম (প্রশাসন) আইয়ুব খান চৌধুরী, সিআইডি’র সাবেক এসপি রফিকুল ইসলাম, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কমিশনার এমদাদুল হক প্রমুখ। এমনকি রেলের নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাও দুদকের করা পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। আফম রুহুল হক ছাড়া আরো যেসব সাবেক মন্ত্রী-এমপির জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দুদক অনুসন্ধান করে তারা হলেন, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সরকারি দলের এমপি আসলামুল হক, এনামুল হক ও আবদুর রহমান বদি, বিএনপির দুই সাবেক এমপি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও মসিউর রহমান এবং জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল জব্বার। তাদের মধ্যে আবদুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর আ’লীগের আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগসমূহ আনা হয়েছিল, সেগুলো খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে রয়েছেন-এইচবিএম ইকবাল, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এটিএম গিয়াসউদ্দিন, সাবেক এমপি আবদুল কাদের খান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী সচিব এম আবদুল মতিন ও চট্টগ্রামের সাবেক এসপি ইফতেখার আহমেদ। অপরদিকে কিছু রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দুদক। এ তালিকায় রয়েছেন বিএনপির মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার, এম মোর্শেদ খান, আলী আসগর লবি ও তার পরিবারের সদস্য, মোসাদ্দেক আলী ফালু, এহছানুল হক মিলন, একেএম মোশাররফ হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার পরিবারের সদস্যরা। দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ১৬২৪টি অভিযোগের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন পেশের আগেই ১২১৫টি দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। ৪০৯টি অভিযোগ বাতিল করা হয় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর। 

দেশের সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তাদের মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ নেয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এই মহাকেলেঙ্কারির জন্য কোন শাস্তি নয় বরং অবসরে পূর্ণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে সরকারের বিশ্বস্ত কয়েকজন সচিব ও যুগ্ম সচিব রয়েছেন। এদের কয়েকজনের সনদ বাতিলের নথিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সই করলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মকর্তা মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের সনদ বাতিল না করে স্থগিত করা হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া ১৫১জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা গেজেট ও সনদ বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসনে এমন মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী পদস্থ কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে জানা গেছে। মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০জন। নিয়ম লঙ্ঘন করে গেজেট প্রকাশ করায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ২হাজার ৩৬৭জনের তালিকা বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এছাড়া সনদ জাল করে চাকরি নেয়ার অভিযোগে আটক হয় পুলিশের ২৩ কনস্টেবল। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রাথমিক শিক্ষক পদে আবেদনকারী এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয়। প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেয়া সাত হাজার সনদধারীকে নিয়েও। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার সরকারি চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। লোভে পড়ে সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ সংগ্রহ করছেন। 

৭ খুনের ইংরেজিতে লেখা ১৬২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এসে পৌঁছেছে। সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্টে এখন ডেথ রেফারেন্স নিশ্চিতকরণের জন্য শুনানি হবে। রায় ঘোষণার পরদিনই মেজর (অবঃ) আরিফসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেকেই জেল আপিল করার জন্য রায়ের অনুলিপি চেয়ে জেল সুপারের মাধ্যমে আবেদন করেছেন। বর্তমানে হাইকোর্টে তিনটি পৃথক বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিতকরণবিষয়ক মামলার শুনানি চলছে। সাধারণত ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক রায় দানের ক্রমিক অনুসারে তৈরি হয়। তবে কোনো পক্ষ দ্রুত পেপারবুক প্রস্তুত করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা চাইতে পারে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে ২০১১-১২ সালের ছয়টি মামলা (মুফতি হান্নানের মামলা আংশিক শ্রুত) শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত আছে। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে ২০১০-১৩ সালের আটটি ও ২০১৫ সালের দু’টি (একটি আংশিক শ্রুত) ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য তালিকায় আছে। এ ছাড়া বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চে সপ্তাহে তিন দিন শুনানি হয়। এই বেঞ্চে ২০০৯ সালের একটি আংশিক শ্রুত এবং ২০১১-১৫ সালের মধ্যকার প্রায় ২১টি ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য কার্যতালিকায় রয়েছে। অনেক আইনজীবির ধারণা, এই মামলার শুনানি ২০২০ সালের আগে শুরু হবে না। তবে রাষ্ট্র উদ্যোগী হলে এর আগে করা অসম্ভব নয়। ক্রমিক এগিয়ে আনার নজির আছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধরে সামাজিক যুদ্ধ শুরু করতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতায় আঘাত আনার অপচেষ্টায় যারা আজ মেতে উঠেছে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। স্বাধীনতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে কোন আপোষ নেই। [সমাপ্ত]

 [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ