শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

৭ খুনের রায়ের পর অনেক কিছু খোলাসা হচ্ছে

জিবলু রহমান : বাংলাদেশে মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে তুচ্ছ হচ্ছে জীবন। কে কোথায় বেঘোরে মারা পড়বে বা ঘাতকের নিশানা হবে, কেউ বলতে পারে না। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যক্তি-বিদ্বেষ সমাজে তীব্র হয়ে উঠেছে। অপহরণ, গুম, খুনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। অথচ কী নির্বিকার আমরা। সমন্বিত প্রতিরোধ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত প্রভাব, সামাজিক প্রতিপত্তির কারণে কিছু অপরাধী ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সভা-সেমিনারে উচ্চারিত হচ্ছে: এ সব রাঘব বোয়ালেরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন দলমত ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এদের শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।
দৈনিক ইত্তেফাক ৩০ এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যার এক প্রতিবেদনে ১২ বছরে ১০ হাজার ১৬১ জন অপহরণ ও নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩শ’ জনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ২,৫০০ জন। ৭,০০০ নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে ৩,০০০ অপহরণকারী ধরা পড়েছে। অপহরণ হওয়ার পর অপহৃত ব্যক্তির স্বজনেরা থানায় ডায়রি করে।
ক্ষমতাসীনরা দেশের আইন-শৃংখলা ভালো রাখার বদলে কিছু ব্যক্তির অমানবিকতাকে আশ্রয় দিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে। গুটি কয়েক ব্যক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতার মসনদ আগলে রেখেছেন শেখ হাসিনা। জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মসনদ আটকে রাখতে ব্যবহার করছেন প্রশাসনকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরটিকে ব্যবহার করে জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে আছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেখা গেছে তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজির আহমেদ, র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ও বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ-শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে বিভিন্ন অমানবিক কাজ সমাধা করেছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পেশাদারিত্ব ছেড়ে বিরোধী মত দমনই তাদের প্রধান দায়িত্ব হয়েছে। বিরোধী মতের ও দেশের নিরীহ-নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর জুলুম নির্যাতন তাদের দ্বারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলেছে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২১ জুন ২০১৪)
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে একসঙ্গে সাতজনকে অপহরণের পর ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে উঠেছিল মানুষ। ক্ষমতাবানদের আক্রোশ যে একজন মানুষের জীবনকে কতটা দুর্বিষহ করতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের ঘটনা। আওয়ামী লীগ শাসন মানেই নারায়ণগঞ্জ ‘আতঙ্ক ও কান্নার শহর।’
১৬ জানুয়রি ২০১৭ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় পাঁচ বাহিনীর সাবেক ১৬ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। এটি সাত খুন হিসেবে পরিচিত হলেও দু’টি পৃথক মামলা হিসেবে এর বিচার হয়েছে। সে কারণে দু’টি আলাদা রায় হয়েছে। একটি মামলায় নিহত নজরুলসহ পাঁচজন এবং অন্যটিতে আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে হত্যা মামলায় রায় ঘোষিত হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তাঁর অপরাধজগতের ৯ সহযোগী। এ ছাড়া ওইসব বাহিনীর আরও নয় সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ক্ষমতার দাপটে প্রভাবশালীদের অপরাধ বিভিন্ন সময়ে মাফ হয়ে যাওয়ার প্রচলিত ধারণা আদালতের রায়ে ভুল প্রমাণিত হলো।
সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী থেকে প্রেষণে র‌্যাবে আসেন। অপরাধ সংঘটনের সময় তাঁরা সবাই র‌্যাব-১১-তে কর্মরত ছিলেন। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন সেনাবাহিনী থেকে, ২ জন নৌবাহিনী থেকে, ৩ জন বিজিবি, সাতজন পুলিশ ও ২ জন আনসার থেকে র‍্যাবে যোগ দেন। সাত খুনের মামলার পর তাঁদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
সাত খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ তো বটেই, গোটা দেশ তোলপাড়। বিচারের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধন করছেন। স্লোগান দিয়েছেন, ঘাতকদের ফাঁসি চাই। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা ছুটেছেন শোকসন্তপ্ত স্বজনদের কাছে। গণমাধ্যমের কর্মীরা ভিড় করেছেন ডিসি-এসপির অফিসে, আদালত চত্বরে-যদি নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়। এক বছর পর যেন সবকিছু স্তিমিত হয়ে আসছে। সময় ও জীবনের দাবি শোককে ভুলিয়ে দিয়েছে। সাইনবোর্ড মোড় থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ সড়কের দুপাশে টানানো ব্যানারগুলো মলিন। পোস্টারগুলো বিবর্ণ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত জনাকীর্ণ এজলাসে এই রায় ঘোষণা করেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি বলেন, অপহরণ, হত্যা, লাশ গুম ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপহরণ ও আলামত অপসারণে যুক্ত থাকায় বাকিদের ১০ বছর ও সাত বছর করে সাজা দেয়া হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, একসঙ্গে এত মানুষকে অপহরণ, হত্যা ও গুমের মতো ভয়ংকর অপরাধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত বিপুলসংখ্যক সদস্যের একযোগে জড়িত হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক রায় এ কারণে নয় যে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনি ছিলেন অপরাধ দমনে নিয়োজিত একটি সরকারি বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদাধিকারীও। এই রায় প্রমাণ করেছে যে অপরাধী যত ক্ষমতাধর হোক না কেন তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেটি দৃষ্টান্ত না হয়ে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হওয়া উচিত।
এটি এ দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মামলা, যেখানে ২৬ জনের ফাঁসি হলো। এই রায়ে সমগ্র জাতি স্বস্তি পেয়েছে। এর মাধ্যমে ভিকটিম ও জনগণ প্রত্যাশিত রায় পেয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো, কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামীরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অবঃ) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মোঃ এমদাদুল হক, এ বি মোঃ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মোঃ শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সৈনিক আবদুল আলিম (পলাতক), সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি (পলাতক), সৈনিক আল আমিন (পলাতক), সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক), সার্জেন্ট এনামুল কবির (পলাতক), নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহমত আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম (পলাতক), সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক) ও জামাল সর্দার (পলাতক)।
১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন (পলাতক) ও করপোরাল মোখলেছুর রহমানকে। আর কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (পলাতক), হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে সাত বছরের কারাদ-ের নির্দেশ দেন আদালত। মোখলেছুরকে অপহরণে যুক্ত থাকার দায়ে ১০ বছর ছাড়াও আলামত অপসারণে যুক্ত থাকার দায়ে আরও সাত বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন বলেন, ‘এখানে দুটি মামলা। দুটি এজাহার। দুটি মামলায় রায় ভিন্ন। ১৭৪৮/১৫ (মামলা নম্বর)-এর দুজন ভিকটিম, ১০৩/১৬ (মামলা নম্বর)-এ পাঁচজন ভিকটিম। দুটি রায় ভিন্ন হলেও ফলাফল এক বিবেচিত হবে। আপনারা কথা বলবেন না। রায়ের অংশবিশেষ পড়ছি।’
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতাকে ‘জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক’, ‘সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন আদালত। এ ঘটনা ‘আমাদের সকলের মাথা লজ্জায় নুইয়ে দিয়েছে’ উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, নূর হোসেন এর মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড)। র‍্যাব সদস্যরা তাঁর সঙ্গে মিলে যৌথভাবে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) এই অপরাধ ঘটিয়েছেন।
আদালত এলিট বাহিনী হিসেবে র‍্যাবের কার্যক্রমের প্রশংসার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই বাহিনীতে প্রেষণে নিয়োগ দিতে সতর্কতা অবলম্বনে গুরুত্বারোপ করেছেন। একই সঙ্গে আদালত সাত খুনের ঘটনাকে প্রধানত ‘দুই সন্ত্রাসীর রেষারেষির ফল’ হিসেবে দেখেছেন। আদালত বলছেন, এই হত্যাকা- মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য।
সৈয়দ এনায়েত হোসেন তাঁর পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্য কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিচারকের ভাষায়, এই হত্যাকাণ্ড দুই সন্ত্রাসীর রেষারেষির ফল। একজন আরেকজনকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে, যার লক্ষ্য হলো সমগ্র এলাকাকে একজনের মুঠোবন্দী করা। রায়ে এটাও ফুটে উঠেছে যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামই শুধু নিশানা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকায় চারজন এবং ‘প্রতিবাদী’ ভূমিকা পালন করায় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়েছে। র‍্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়েও নূর হোসেনের সঙ্গে কী করে মেজর আরিফ নিয়মিত ও প্রকাশ্যে তাঁর অফিস ও বাড়িতে যাতায়াত করেছেন, অবৈধ অর্থ হাতিয়েছেন-তা রায়ে বিস্তারিতভাবে চিত্রিত হয়েছে।
আদালতের রায়টি মূলত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দীনির্ভর। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নরসিংদীর র‍্যাব কর্মকর্তা মেজর সুরুজ, যাঁর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে মেজর আরিফ অপহরণের পরে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন, তিনিসহ দু’জন বাসযাত্রীর সাক্ষ্য রয়েছে।
আদালত বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এঁদের ২৫ জনই রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং ১০ জন অভিযুক্ত বেসামরিক লোক। তথ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা সহজেই অনুমেয় যে প্রতিটি গ্রুপ তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে একটি পূর্বপরিকল্পনার আওতায় বেআইনী তৎপরতা চালিয়েছে। নূর হোসেন গ্রুপ যৌথভাবে অন্য গ্রুপের (অভিযুক্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য) সঙ্গে পারস্পরিক সলাপরামর্শ করে নিজেদের সুবিধা চরিতার্থ করতে অপরাধ করেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যরা নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরনের তিরস্কারযোগ্য যোগসাজশ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা সর্বদাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত লাভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। রায়ে বলা হয়, নূর হোসেনের সঙ্গে নিহত নজরুলের বিরোধ ছিল। নূর হোসেন যেহেতু র‌্যাবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সে কারণে নূর হোসেন সেই সুযোগ নিয়ে প্রতিরক্ষা সদস্য ও অন্যদের দিয়ে এ অপরাধ সংঘটনে সফল হয়েছিলেন। নূর হোসেন এই নৃশংস অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী।
আদালত বলেন, নিহত নজরুল এবং অভিযুক্ত নূর হোসেন উভয়ে সমাজবিরোধী এবং সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। এঁদের একজন বর্তমানে আওয়ামী লীগের (এর আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) রাজনীতির অনুসারী হয়েছেন। অন্যজন বিএনপির অনুসারী। সন্ত্রাসীরা কোনো রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী নয়। তারা কেবল ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে নূর হোসেন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নজরুল এবং অন্যদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তাঁরা তাঁদের অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ উধাও করেছেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, ‘র‌্যাব একটি প্রশংসাযোগ্য এলিট বাহিনী। প্রেষণে কর্মরত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ও বিবেকহীন অপরাধীর দ্বারা এই বাহিনী কলঙ্কিত (রেপড) হতে পারে না। রায়ে বলেন, ‘আমার কাছে র‌্যাব হলো দায়িত্বশীলতা (রেসপনসিবিলিটি), নৈপুণ্য (এবিলিটি) ও বদান্যতার (বেনিফিশিয়েন্স) প্রতীক। আমাদের সকল জাতীয় সংকটে র‌্যাব তার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। সুতরাং র‌্যাবের অভিযুক্তরা ব্যক্তিগত দায় নিয়ে বেআইনী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। একজন ব্যক্তির দায়িত্বহীনতার কারণে পুরো এলিট বাহিনী সমালোচনার শিকার হতে পারে না।’
রায়ে আদালত বলেন, র‌্যাব একটি এলিট ফোর্স হিসেবে কথিত অপরাধ সংঘটন করেনি। এই অপরাধ ব্যক্তির স্বার্থে ও ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যরা ঘটিয়েছেন। কোনো হত্যাকা-কে আইন সমর্থন করে না। তথ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রমাণ করে যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তিরা ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যৌথভাবে নিহত ব্যক্তিদের অপহরণ এবং পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেন।
আদালত বলেন, সব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আসামীদের জবানবন্দীর পর্যালোচনায় এটাই ফুটে উঠেছে যে অপরাধীরা তাঁদের অপরাধ স্বীকার করেছেন। অপহরণ, ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, হত্যা, আলামত নষ্ট করার বিষয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের জবানবন্দীতে দেয়া ভাষ্য পুরোপুরি সত্য, যা তাঁরা স্বেচ্ছায়, ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়েছেন। প্রসিকিউশন তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে, তার বিবরণের সঙ্গে আসামীদের দেয়া বৃত্তান্ত মিলে গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কোনো বাধা নেই। এটা স্পষ্ট যে অভিযুক্ত নূর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ, এম এম রানা, এমদাদুল হক, মোঃ আরিফ হোসেন, হীরা, বেলাল, আবু তৈয়ব, শিহাব উদ্দিন, পূর্ণেন্দু বালা, আসাদুজ্জামান নূর, চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু ওরফে মিজান, রহম আলী, আবুল বাসার, আবদুল আলীম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবির, সেলিম, সানাউল্লাহ ওরফে সানা, শাহজাহান এবং জামাল উদ্দিন হত্যার উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটন করেছেন।
নূর হোসেনের অফিসে ষড়যন্ত্র হয়েছিল উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নূর হোসেন, দীপু, আলী মোহাম্মদ, চার্চিল, রহম আলী, বাসার, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন হত্যার উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছিলেন। অভিন্ন পরিকল্পনায় গৃহীত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যেকেরই পূর্ণ ধারণা ছিল এবং খুন করার উদ্দেশ্যে নূর হোসেন ছাড়া অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কাঁচপুরে যান। ঘটনায় নূর হোসেনের ব্যক্তিগত উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তিনি এই অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি অপহরণ থেকে হত্যা পর্যন্ত তদারকি করেছেন। অভিযুক্ত আলী মোহাম্মদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে প্রতীয়মান হয় যে নূর হোসেন নিজে আলী মোহাম্মদ, শাহজাহান, সানাউল্লাহ, বাসার, চার্চিল, রিয়াজ, সেলিম, জামাল, হাসান, রহম আলী, আনোয়ার, জজ মিয়া এবং অন্যদের উপস্থিতিতে অশালীন ভাষায় বলেছেন, নজরুল তাঁকে দারুণভাবে হয়রানি করেছেন। তাই নজরুলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জবানবন্দীতে এই অপরাধে তাঁদের এবং অন্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ স্বীকার করেছেন।
শুধু গুম-খুন নয়, নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাবে কর্মরত থাকার সময় ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে দু’হাতে তিনি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর এসব নিষ্ঠুর পথ বেছে নেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা অবৈধ পথে অর্জিত এসব অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশেও পাচার করেন। সাত খুনের অভিযোগে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় প্রথমদিকে অন্তত সাড়ে ৬ কোটি টাকা দেশের বাইরে সরিয়ে নেয়া হয়। তিনি কারাগারে আটক থাকায় অবৈধ টাকা পাচারে মূল ভূমিকা পালন করেন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ তিন ব্যক্তি। এরা হলেন জনৈক রিয়া, রনি ও হেমা। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তারা বিশেষ সুবিধায় নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় টাকা পাচার করতে সক্ষম হন।
সাত খুনের ঘটনার পর র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্তকৃত) আরিফ ও লে. কমান্ডার (বরখাস্তকৃত) এমএম রানা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাদের ঘনিষ্ঠ লোকজনের মোবাইল ফোনে আড়ি পাতেন গোয়েন্দারা। একপর্যায়ে রিয়া, রনি ও হেমার মোবাইল ফোনালাপে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের বিষয়টি ধরা পড়ে।   [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ