বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

দস্তয়ভস্কি (১৮২০-৮১)

বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস : বিশ্বসাহিত্যের দু’জন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের অন্যতম দস্তয়েভস্কি। অথচ দুর্ভাগ্য তাঁকে আজীবন রাহুল মতই তাড়া করেছে। রাজনীতির শিকার হয়ে তিনি প্রথম যৌবনেই মৃত্যুদ- লাভ করেছেন এবং মান এক পলের জন্য মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে কখনও তিনি রেহাই পাননি। দীর্ঘকাল সাইবেরিয়ায় সাশ্রম কারাদ- ভোগ করেছেনÑ এক অমানুষিক অবস্থার মধ্যে এক কঠোর দুরারোগ্য ব্যাধি সারাজীবন ভুগেছেন। জীবনটা তাঁর কেটেছে অস্থিরতা আর উদ্বেগের মধ্যে। তাই অস্তিত্বের প্রশ্নটি তাঁর কাছে জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে। বিচিত্র ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার রসে সমুজ্জ্বল তাঁর জীবন। এবং তাই তাঁকে মহৎ শিল্পীতে রূপান্তরিত করেছে।
এক অসচ্ছল মধুবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা হলেন মস্কোর এক দাতব্য চিকিৎসালয়ের ক্ষুদে ডাক্তার। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান ফিদরে দস্তয়েভস্কি। মা-বাবা আর পাঁচ ভাই-বোন মিলে দুই কামরার একটি ফ্ল্যাটে বাস করেছেন। বড় ভাই মাইকেল আর তিনি ছেলেবেলায় ছোট্ট একটি ঘরে থেকেছেন। জন্মাবধি তিনি যে দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন তা তাঁকে আমৃত্যু ঘিরে থাকে। অর্থাভাবে তিনি সারাটা জীবন ভুগেছেন এবং যখন কোন সুযোগে কিছু টাকা হাতে পেয়েছেন তাও দু’হাতে ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছেন। ঝাঝরির মতই দেন তাঁর হাতের ফুঁটো দিয়ে টাকা গলে বেরিয়ে গেছে। টাকা-পয়সা তিনি কখনও হিসাব-নিকাশ করে খরচ করেননি।
ছেলেবেলায় তিনি ভাইয়ের সাথে মস্কোর একটি ছোট্ট স্কুলে পড়েছেন। যেখানে শিক্ষক তাঁকে সাহিত্যে আগ্রহী করে তোলেন। পুশকিনের কবিতা, স্কচের উপন্যাসের সাথে তাঁর পরিচিতি ঘটে এবং শিলারের রবারের অভিনয় তিনি দেখেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার পর সেন্ট পিটার্সবার্গে ভাইয়ের সাথে তাঁকে পাঠানো হয় মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়ার জন্যে। পথিমধ্যে একটা ঘটনা তাঁকে দারুণভাবে নাড়া দেয় এবং রাশিয়ার নগ্ন বাস্তব জীবন অকস্মাৎ তাঁর চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এক সরকারি অফিসার গাড়ি দ্রুতগতিতে চালানোর জন্যে কোচোয়ালকে ঘুষি মারতে থাকে। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, ‘এই ঘটনা তাঁর স্মৃতিতে চির জাগরুক হয়ে থাকে। এই ঘটনার ফলেই দশ বছর পর তিনি বিপ্লবের পথে পা বাড়ান।
সেন্ট পিটার্সবার্গ এশে দেশী-বিদেশী সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ আরও প্রবল হয়ে উঠে। শিলার, গ্যেটে, সেক্সপীয়র, বালজাক, ডিকেন্স, জর্জ সাঁদে, হোমারে তিনি আকৃষ্ট হলেন। কাব্য ও সাহিত্যে তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়। হোমারকে তিনি ভালবাসলেন।
ষোল বছর বয়সে তিনি মা’কে হারালেন। বাবা লম্পট ও দুর্বৃত্ত ধরনের। বাবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে মস্কোর কাছে তাঁর ছোট্ট একটি জমিদারীতে বসবাস শুরু করলেন (১৮৩৭)। কিন্তু তাঁর অত্যাচারে প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। ফলে প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে হত্যা করে (১৮৩৯)।
বাবার হত্যার ঘটনাটি সম্পর্কে দস্তয়েভস্কি আশ্চর্য মৌনতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু এ নিঃসন্দেহ যে, এই গটনা তাঁর মনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করে। ফলে ভূমিদাস সমস্যা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। পরবর্তীকালে তিনি রুশ দেশের চাষীদের সকল খৃস্ট্রীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ দেখেছেন।
ইঞ্জনিয়ারিং স্কুল থেকে পাস করে ২৩ বছর বয়সে তিনি রুশ সেনাবাহিনীতে সাব-লেফট্যালেন্ট-এর পদ লাভ করেন (১৮৪৩)। বালজাকের Eugeric grandet-এর স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেই তার সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রথম অবতরণ (১৮৪৪)। ঐ বছরেই তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন।
প্রথম উপন্যাস ‘অভাজন’ (১৮৪৬) সম্ভবত: দস্তয়েভস্কি স্কুল জীবন থেকে লেখা শুরু করেন। এটি রিভিউর জন্য পাঠিয়ে ফলাফলের আশায় তিনি গভীর উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু সাফল্যের সম্পর্কে হতাশা হয়ে তিনি একদিন ভোর চারটায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেই। ঠিক সে সময় কবি নেকরাসভ এবং সমালোচক গ্লিগোরোভিচ এসে তাঁকে বললেন, “জানো তুমি কি লিখেছ? এই ধরনের বই থেকে সুস্পষ্ট যে, তোমার মধ্যে শিল্পীর প্রতিভা রয়েছে।”
দস্তয়েভস্কি বলেছেন, এটাই তাঁর জীবনের সুখের চরম মুহূর্ত। বইটি লেকরাসভের পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যিক হিসাবে তিনি বেশ খ্যাতিলাভ করেন।
কিন্তু ভাগ্য তাঁকে চিরকাল চরম ব্যর্থতা ও সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দ্বিতীয় গল্প ‘দ্বৈত’ ব্যর্থ হবার ফলে বন্ধুরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভাবলেন, তাঁরা ভুল করেছেন। তখন থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবন একটানা সংগ্রামের- শুধু দারিদ্র্য নয়, ব্যাপক জনমতের সাথে তাঁকে বুঝতে হয়েছে। দস্তয়েভস্কি এ সময় রুশ কম্যুনিস্ট রাজনীতির এবং সাহিত্য সমালোচকদের শিকারে পরিণত হলেন।
সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে তিনি রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। তিনি বামপন্থী পেত্রোলেভস্কি চক্রের সাথে যুক্ত হলেন। এই দলের এক শুক্রবারীয় বৈঠকে বক্তৃতাদানকালে তিনি সেন্সরশিপ থেকে মুক্তি, ভূমিদাস প্রথার অবসান, বিচারালয়ের সংস্কার সাধনের দাবি উত্থাপন, এমনকি বিদ্রোহের বাণী ও উচ্চারণ করে (১লা এপ্রিল, ১৮৪৯)। রাজনৈতিক কার্যকলাপের দরুন ঐ মাসের ২৩ তারিখ অন্যান্যদের সাথে তাঁকে গ্রেফতার করে পীতর পাভেল দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়।
পেত্রোলেভস্কি চক্রের বিচার সামরিক ট্রাইব্যুনালে চলে। বিচার শুরু হয় ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ১৮৪৯ এবং শেষ হয় ঐ বছরের ১৬ই ডিসেম্বর। অভিযুক্তদের মধ্যে কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে তাঁর প্রতি নজর দিয়েছেন, দলের অন্যদের দোষ স্খালনের প্রয়াশ পেয়েছেন এবং নিজস্ব মতবাদ- ভূমিদাসদের সম্পর্কে, সেন্সরশিপ বিলোপ প্রসঙ্গে এবং রাজনৈতিক স্বাধিকার বিষয়- জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি সব সময় নিজের মতবাদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন। বিচারে তাঁকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়।  একদিন খুব ভোরে তিনি আদেশ পেলেন- গুলী করে তাকে হত্যা করা হবে। মাত্র ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আরও ঊনিশজনসহ তাঁকে সেমিওনস্কি স্কোয়ারে নিয়ে যাওয়া হল কড়া পাহারার। খোনে ফাঁসির আসামীর সাদা জামা পরানো হল তাঁদের। স্কোয়ারের মধ্যস্থানে একটা ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে তাঁদের দুই সারিতে দাঁড় করানো হল। এমন সতর্কভাবে তাঁদের পাহারা দেয়া হয় যে, নিকটতম এক সাথী অপর সাথীর সাথে ও দু’ একটার বেশি কথা বলার সুযোগ থাকল না।
একজন শেরিফ মঞ্চের উপরে এসে দাঁড়ালেন এবং ফাঁসির আজ্ঞা পাঠ করে শোনালেন। এক্ষুণিই ফাঁসি হবে।
‘Sentonsed To be shot’ এই ভয়ঙ্কর হুকুম বিশবার অথচ পেত্রোলেভস্কি চক্রের শদস্যরা ভয়ঙ্কর কোন জীব-জন্তু নয়। সে সময় বেলিনস্কি প্রমুখ গণতন্ত্রী চিন্তাধারীদের ভাবনার প্রভাব- শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও রেখাপাত করে। কয়কজন উদারপন্থী শিক্ষিত যুবক পেপ্লোলেভস্কির ঘরে বসে আলাপ-আলোচনায় এক বিতর্কে লিপ্ত হয়। এই সব উদারপন্থী যুবকরা ইউটোপিয়ায় স্বপ্ন দেখে। পেত্রোলেভস্কির ঘরে তাদের এই আড্ডা বসে বলে এটা পেত্রোলেভস্কির চক্র বলে অভিহিত। রাজনৈতিক কারণে এই চক্রটি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে।
উচ্চারিত হলো। এই কথাগুলো তার মনের মধ্যে এমনভাবে দাগ কাটে যে, বহু বছর পরে প্রায় রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং মনে হয় যেন তিনি সেই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় মেঘের আবরণ ভেদে করে সূর্যালোক দেখা দিল। এ থেকেই তার দৃঢ় প্রত্যয় হল যে, ‘এ অসম্ভব। তারা আমাকে হত্যা করতে পারে না’। এই কথাগুলো তিনি পার্শ্ববর্তী সঙ্গীর নিকট অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন। কিন্তু সে কোন জবাব না দিয়ে মঞ্চের নিকট এক সারি কফিনের দিকে দেখিয়ে দিল। যান শেষ মুহূর্তে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন-জারের কৃপায়।
দম্ভয়েভস্কির সহযোগী এক বন্দী গ্রিগোরিয়েভ উন্মাদ হয়ে যান। কিন্তু মৃত্যুর এই ভয়ঙ্কর উপলব্ধির ফলে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত তীব্র ও তীক্ষ হয়ে উঠে। মৃত্যুর কোল হতে তিনি ফিরে এলেন বটে, কিন্তু তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে পাঠানো হল সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে। তাও দশ বছরের জন্য। প্রথম চার বছর ওমস্ক-এর কারাগারে বন্দিরূপে। বাকি দশ বছর সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক কঠোর শ্রম করার জন্য।
কারাগারে তার সহবাসী ও সহযোগী হল সমাজে যারা অত্যন্ত ঘৃণ্য- যারা জঘন্যতম অপরাধে অভিযুক্ত। তার সেই জীবনের পরিচয় বিধৃত হয়েছে ‘মৃত পুরী’তে।
কারাবাসকালে দস্তয়েভস্কিকে নিদারুণ দুঃখভোগ করতে হয়েছে। মেজর ক্রিভজব কারাগারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী এবং তাকে একটি নরপশু বলে নিঃসন্দেহে অভিহিত করা যায়। সে কোন না কোন একটা ছুতো ধরেই কয়েদীদের চাবকাতে থাকে।
দস্তয়েভস্কিকে অনেক সময় বিশ্রী আবহাওয়ায়, ঘন কুয়াশায় কাজ করতে হয়েছে- এমন ঠান্ডা যে জমে যাবার উপক্রম। তাছাড়া, তাকে অন্যান্য কয়েদীর সাথে একটা পুরনো ভাঙ্গা নড়বড়ে ঘরে থাকতে হয়েছে। ঘরটা শীতের সময় অসম্ভব ঠান্ডা, গরমের সময় অসহ্য গরম আর সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে থাকে। এভাবেই কারাগারে তার দিনগুলো কাটে অসীম যাতনা ও দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে।
চার বছরের মেয়াদ শেষ হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হল সেমিপলতিনস্ক শহরে (২রা মার্চ, ১৮৫৪)। এখানে তিনি বাধ্যতামূলকভাবে সপ্তম সাইবেরিয়ান লাইন রেজিমেন্টে সাধারণ সৈনিক হিসাবে কাজ করেন। এখানে তিনি এক ক্ষুদে সরকারি চাকুরের ক্ষয়রোগগ্রস্তা (এবং সর্বোতভাবে নির্গুণ) বিধবার প্রেমে পড়েন। মেরি এক দরিদ্র শিক্ষককে ভালবাসলেও সন্তানের খাতিরে অগত্যা তাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। উল্লেখ্য যে, মেরির নয় বছরের একটি ছেলে আছে এবং ছেলেটি জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। অথচ, এই বিয়ে তাদের কারো জন্যে সুখপ্রদ হয়নি। অর্থের টানাপোড়েনে তাদের দাম্পত্য জীবন বিষময় হয়ে উঠে।
একদিকে দারিদ্র্যের জ্বালা অপরদিকে স্থায়ী রোগের প্রকোপ, এই দুই মিলে তার জীবন অভিশপ্ত করে তুলেছে। বলা হয়, কারাবাসকালে তার মধ্যে মৃগীরোগের লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু একথা যথার্থ নয়। একজন জীবনীকার ইঙ্গিত দিয়েছেন, পারিবারিক জীবনের কোনও দুর্ঘটনা অবলম্বন করে কৈশোরে তার মধ্যে এ রোগের সূচনা ঘটে। আর সমস্ত জীবন এই রোগে তিনি ভুগেছেন।
মৃগী রোগের দরুণ তার মধ্যে অস্বাভাবিক দেখা দেয়। তিনি অত্যন্ত উগ্র হয়ে উঠেন এবং প্রচ- আবেগের বশবর্তী হন।
রোগের আক্রমণ সাধারণত মাসে একবার, আবার কখনও কখনও বেশিই হয়েছে- কোন সপ্তাহে দু’বারও। বন্ধু ট্রাকভ এই আক্রমণের প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন।
‘তিনি কিভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, আমি একবার দেখেছি। সেটা সম্ভবত ১৮৬৩ সাল- ঠিক ঈস্টারের আগে। সন্ধ্যার পর, ১১টা বাজে, তিনি আমাকে দেখতে এলেন। আমাদের দু’বন্ধুর মধ্যে বেশ প্রাণখোলা কথা-বার্তা হয়। বিষয়টি ঠিক কি তা আমার মনে নেই। কিন্তু মনে আছে বিষয়টি খুব জরুরি ও জটিল। তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলেন আর আমি টেবিলে বসে রইলাম। তিনি চমৎকার কিছু বললেন। আমি তার মতামত সমর্থন করলাম। হঠাৎ তার চোখে-মুখে এক অনির্বচনীভাব ফুটে উঠল। তিনি মুহূর্তের মধ্যে হাসলেন, যেন শব্দমালা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন এবং বলার জন্যে হাঁ করেছেন। তার মুখ দিয়ে দৈববাণী নিঃসৃত হবে, এই আশায় তাকালাম। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি মূর্ছিত হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে গেলেন।’
প্রাচীনেরা এই রোগকে পূত পবিত্র রোগ বলে অভিহিত করেছেন। আক্রান্ত হবার পূর্ব মুহূর্তে তিনি এক ধরনের উল্লাস অনুভব করেছেন। অনেকটা মহান সঙ্গীত শোনার সময় লোকে যেমন অনুভব করে থাকে। তার সাথে সমস্ত জগতের যেন পরিপূর্ণ একতান। এই অনুভূতি এত তীব্র তীক্ষ যে, মাত্র কয়েকটি পলে যেন তিনি জীবনের দশটি বছর, এমনকি সমগ্র জীবন অতিক্রম করে যান। কিন্তু আক্রান্ত হবার শেষে তার অবস্থা সঙ্গীন হয়ে যায়- যে বিষণ্নতা দেখা দেয়, তা সহ্য করা তার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠে। নিজেকে চরম অপরাধী বলে মনে হয়- যেন কোনও অদৃশ্য পাপের রোগ তার মাথার উপর ঝুলছে। পূর্বের আনন্দানুভূতি এবং পরের গ্লানিবোধ, এই দুই মিলে তার মধ্যে এক অদ্ভূত মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে।
এই ধরনের ঘন ঘন আক্রমণের ফলে তিনি চরিত্রের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, হয়ে উঠেন উগ্র মেজামী ও অস্থিরচিত্ত। অথচ এই আক্রমণের ফলে তিনি জীবনের গভীরে দৃষ্টিপাত করতে সমর্থ হয়েছেন এবং এমন গভীরভাবে আর কোন শিল্পী-সাহিত্যিক নয়।
মৃগী রোগের প্রকোপের ফলে তার পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হয়ে উঠে। দস্তয়েভস্কি শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। সাইবেরিয়া থেকে তিনি ফিরে আসেন ২ জুলাই ১৮৫৮।
দশ বছর কারাজীবনে অশেষ দুঃখভোগের ফলে তার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে। তাই সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে এসে তিনি পেনোলেভস্কি দলের বিপ্লবী মতবাদ পরিহার করলেন। তিনি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন, ভ্রিমিয়া। তার ধারণা, পত্রিকায় প্রকাশ করলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে এবং তিনি দারিদ্র্যের হাত থেকে রেহাই পাবেন। কিন্তু বিধি হলো বাম।
পোল্যান্ডের ব্যাপারে দীর্ঘ এক প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়।
এই সময় জুয়ার সর্বনাশা নেশা তাকে পেয়ে বসে। জুয়ার নেশায় তিনি রাত-দিন ডুবে রয়েছেন। জুয়ায় জিতে তিনি কখনও উৎকট উল্লাস, আবার কখনও হেরে গিয়ে দারুণ অবসাদ অনুভব করেছেন। শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত না খুইয়ে তিনি আদৌ শান্তি পাননি।
১৮৬২’তে তিনি প্রথম বিদেশে যান। লন্ডনে গিয়ে শিল্পবিপ্লবের কুৎসিত দিকটি তার চোখে পড়ে। পারী গিয়ে তিনি তৃতীয় নেপোলিয়নের বুর্জোয়া শাসন-ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হন। এই সকল অভিজ্ঞতা ‘‘Winter notes on summer Impressions’’-এ বিধৃত হয়েছে।
১৮৫৩’তে দস্তয়েভস্কি ঋণের দায়ে আবার বিদেশে পাড়ি জমান। সাথে নিয়ে গেলেন রক্ষিতা এ্যাপোলিনারিয়া সুসলোভাকে। অথচ, সে সময় তার স্ত্রী বেঁচে আছেন।
এ্যাপোলিনারিয়া সুসলোভা ওরফে পোলিনী’র সাথে তিনি এক বিচিত্র সম্পর্কে বিজড়িত হয়ে পড়েন। পোলিনী বেশ আবেগময়ী অথচ, ভয়ঙ্কর স্বাধীনচেতা। তার চরিত্রে কোমলতা ও কঠোরতার অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে। তিনি তার প্রতি প্রবল আসক্তি অনুভব করেন। তরুণী এই ছাত্রীটি তাঁর রক্ষিতা হয় ১৮৬২-এ।
সে সত্যি এক আশ্চর্য ধরনের যাদু জানে। লাস্যময়ী এই তরুণীর হাসি তাঁকে অত্যন্ত সমোহিত করেছে। অথচ, পোলিনার প্রেম তাঁর জীবনে দারুণ হতাশা এনেছে, অনেক তিক্ত মুহূর্তের সৃষ্টি করেছে, আবার একই সাথে তাঁকে সৃষ্টির প্রেরণা যুগিয়েছে। তারই আদলে তিনি ‘জুয়াড়ী’ উপন্যাসের (১৮৬৬) পলিয়ানা এবং ‘নির্বোধ’ উপন্যাসের (১৮৬৬) নাতাশিয়া ফিলিপভনার চরিত্র অংকন করেছেন।
এদিকে তিনি পোলিনার ভালবাসায় বিভোর হয়েছেন, অপরদিকে ঋণের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। এই অস্থিরতাও যন্ত্রণা ভোলার জন্যে তিনি জুয়ার সর্বনাশা নেশায় মত্ত হয়েছেন এবং প্রায় শেষ কপর্দকটি হারিয়ে শূন্য হাতে ঘরে ফিরে এসেছেন। প্রুফ দেখা, টাকার ব্যবস্থা, এমনকি সেন্সরশিপ থেকে ছাড়পত্রের ব্যবস্থাও তাকেই করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে পত্রিকাটি তিনি চালাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় (১৮৬৫)। তিনি দারুণভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এক বন্ধুকে তিনি গভীর বেদনা ও হতাশায় লেখেন, ও I would gladly to go back to prison if only to pay off my debt and to feel myself free once more. . অর্থাৎ ঋণ শোধ করে মুক্তি হওয়ার চাইতে আমি স্বচ্ছন্দে জেলে যেতেও রাজী আছি।
এই সময় তাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলেন স্টেলভস্কি। এই প্রকাশক লোকটি এক দুর্দান্ত বদমাশ। সে তাঁকে আগামী বইয়ের রয়্যালটি বাবদ তিন হাজার রুবল দেয় (২ জুলাই, ১৮৬৫) এবং আদালতের স্ট্যাম্পযুক্ত দলিলে স্বাক্ষর আদায় করিয়ে নেন। শর্ত এই যে, পরের বছর ১৮৬৬-র ১ নভেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ষাট হাজার শব্দের একটি নতুন উপন্যাস লিখে দিতে হবে। যদি ঐ তারিখের মধ্যে পান্ডুলিপি দেয়া না হয়, তাহলে লেখকের অতীতের সমস্ত রচনা এবং ভবিষ্যতে তিনি যা লিখবেন তার সমস্ত কিছুর আইনসম্মত প্রকাশক হবেন স্টেলভস্কি এবং এই বাবদ লেখক একটি কোশেকও পাবেন না।
তিনি হাজার রুবল হাতে পেয়ে তিনি এক মুহূর্ত না ভেবে দলিলে সই করে দিলেন। অথচ এই টাকার প্রায় সবটাই সাথে সাথে দিয়ে দিতে হল পাওনাদারদের এবং মাইকেলের বিধবাকে।
আর্থিক অনটন ও মানসিক উদ্বেগের ফলে তাঁর পক্ষে নতুন কোন উপন্যাসে হাত দিতে পারেননি। অথচ, এদিকে স্টেলভস্কিকে উপন্যাস দেয়ার শেষ তারিখ এগিয়ে আসছে। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। বন্ধুরাও উদ্বিগ্ন। তাড়াতাড়ি উপন্যাস লেখার জন্যে বন্ধুদের পরামর্শে তিনি আনা স্মিতকিনাকে স্টেলো নিযুক্ত করলেন।
শুরু হল উপন্যাস লেখা- তার সেই উপন্যাস ‘জুয়াড়ী’। মেষ হল এক মাসের মধ্যে ১৮৬৬’র ৩০শে অক্টোবর। নির্ধারিত তারিখের আগের দিন মাত্র। শেষ করেই তিনি ছুটে গেলেন স্টেলভস্কির দোকানে পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে। গিয়ে দেখলেন স্টেলভস্কি সাতদিন আগেই পিটার্সবার্গ থেকে কোথায় চলে গেছে, তার কর্মচারীরা পান্ডুলিপিটি নিতে রাজী হল না। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এটা একটা পরিকল্পিত চক্রান্তÑ তাঁকে ফাঁদে ফেলার। তিনি বিষন্নচিত্তে রাস্তায় নেমে এলেন।   (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ