বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

রাষ্ট্রপতির সংলাপের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : সমাবেশের জন্য বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও অনুমতি না পাওয়া, সরকারি দলের উস্কানিমূলক বক্তব্য, যেমন-বিএনপির আন্দোলনের ন্যূনতম সক্ষমতা নেই, পাঁচ শতাধিক কমিটির নেতারা রাজপথে নেমে দেখাক, সাহস থাকলে রাজপথে আসুন, দেশের মানুষ ২০ দলীয় জোটকে চায় না। কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা, যখন-তখন গ্রেফতার-গুম এমনকি হত্যা, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নানা অপপ্রচার, হর-হামেশা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বিষোদগার। সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত এমন বক্তব্য এবং নির্যাতন সত্ত্বেও রাজপথের আন্দোলন থেকে বিরত রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন দেশের প্রধান বিরোধী জোট। জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আহ্বানে অনুষ্ঠিত সংলাপের ফলাফলের উপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম। এছাড়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথে ক্ষমতাসীনরা বেশ পুলকিত থাকলেও রাজপথের বিরোধী দল সেখানে অনুপস্থিত। কৌশলে যাদের রাজপথে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর এসব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে হালে পানি পাচ্ছে না নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সফল বিএনপি। পদে আছে, মাঠে নেই- এমন নেতৃত্ব, বিএনপিকে দুর্বল করছে।

দলটির নীতি-নির্ধারক স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে বাধা দেয়ার বিষয়টি সরকারের কাছে যেমন নতুন নয়, তেমনি জনগণের কাছেও নয়। এতে হিতে বিপরীত হবে। আওয়ামী লীগ অধিকার হরণ করতে চায়। সরকার কর্মসূচি পালন করতে না দিলে বিএনপির উদ্দেশ্য ব্যহত হবে না, বরং জনগণ বিক্ষুব্ধ ও আহত হবে। জনগণ এটি আরো ব্যাপকহারে গ্রহণ করবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যদি সংকট তৈরি হয় তাহলে তার দায় সরকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকেও নিতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি এবং জনগণ প্রত্যাশা করে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে জনগণের মতামত উপলব্ধি করে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সার্চ কমিটি গঠন করবেন। যারা পরবর্তীতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। তিনি বলেন, সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে মিথ্যাচার করছে। বিএনপিকে দাবিয়ে রাখতে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকবে বলেও মনোভাব পোষণ করছে। কিন্তু ইতিহাস বলে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যায় না। কেউ কোনো দিন পারেনি।

জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিসহ বিভিন্ন সময়ে দলের কর্মসূচিকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের হুমকি যেমন আমলে নিচ্ছে না বিএনপিসহ বিরোধী জোট, তেমনি উত্তেজনা-সংঘাতও এড়াতে চাইছে তারা। দেশের অতীতের হামলা-সংঘাতের সাথে বিরোধী জোটের কোনো সম্পর্ক নেই এটি জনগণকে বুঝাতে চায় তারা। যদিও বরবার এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারি দলের নেতাকর্মীরাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় দেশে অরাজকতা করছে। তাদের মতে, গত দুই বছরে সরকারি দলের কর্মকাণ্ডেই প্রমাণ হয়েছে-২০ দলীয় জোট সংঘাতে বিশ্বাস করে না। তবে বিএনপিসহ বিরোধীদের কর্মসূচি পালন করার অধিকার রয়েছে জানিয়ে নেতারা বলছেন, শান্তিপূর্ণভাবেই তাদের কর্মসূচিগুলো পালন করা হবে। সরকার তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে বাধা দিলে বা অনুমতি না দিলে কঠোর কোন কর্মসূচিতে যাবে না তারা। কর্মসূচি পালন করতে না দিলে জনগণই এসব কর্মকাণ্ডের একদিন বিচার করবে বলেও মনে করেন জোটের নেতারা।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, প্রায় দুই বছর ধরে রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি থেকে অনেকটা দূরে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দলকে গুছিয়ে নেয়া, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা না হওয়া, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন ইত্যাদি। সূত্রটি জানায়, এরই মধ্যে বিএনপির অঙ্গ দলগুলোর নতুন কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে যুবদল ও জাসাসের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। অপেক্ষায় রয়েছে কৃষক দল, ওলামা দল ও ছাত্র দল। 

নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা জানান, নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে বিএনপির আগামী দিনের কর্মসূচি। ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি যদি দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারেন, তাহলে বিএনপি ধাপে ধাপে সরকার পতনের আন্দোলনের কর্মসূচির দিকে যাবে। নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেই এখন তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ দলটির। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামতের বাইরে এসে ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন কমিশন গঠন হলে সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে এসে ফের রাজপথেও দেখা মিলতে পারে দলটির। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতির চাহিদা বিবেচনায় রাজনীতিতে কৌশল পাল্টানোর কথাও বলছেন বিএনপির এই নেতা।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য স্বাধীন ইসি ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের বিকল্প নেই। সেটি না হলে হারানো গণতন্ত্র ফিরবে না। গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি সংগ্রাম করছে, ভব্যিষ্যতেও রাজপথের সংগ্রাম চলতেই থাকবে। 

এদিকে সময়মতো রাজপথে নামার ইঙ্গিত দিয়ে জনগণকে আস্থা না হারানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকাটা কৌশল। বিএনপি রাজপথে নাই- এ কথা সত্য নয়। আমরা রাজপথে আছি। সময় ও সুযোগমত আবারও আসবো। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আস্থা রাখুন। তার নেতৃত্বেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাব।

স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে নির্বাচনকালীন একটি ‘সহায়ক সরকার’ চাইছে বিরোধী জোট। এই সরকারকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘ক্লোন’ বলছে অনেকে। তবে আলোচনার মাধ্যমে এর কাঠামো নির্মাণ হলে তা তত্ত্বাবধায়কের মতো হবে না বলে মনে করছে বিএনপি নেতারা। যদিও এখন পর্যন্ত সেই সরকারের রূপরেখা দেয়নি। তবে দলটির নেতারা বলছেন, খুব শিগগিরই এই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য ‘সহায়ক সরকার’ এর রূপরেখা দেয়া হবে।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় ইসি গঠনে বিএনপি বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে। মূলত গত বছরের ১৮ নবেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে খালেদা জিয়া যেসব প্রস্তাব তুলে ধরেছেন সেগুলো বিএনপির মতামত বলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরেন দলটির নেতারা। এর মধ্যে ‘সব দলের’ মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, এই কমিশন হতে হবে ‘সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব রাজনৈতিক দলের’ মতৈক্যের ভিত্তিতে। ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ঠিক করতে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতিনিধিসহ সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। এ আলোচনায় নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে সৎ, যোগ্য ও দল নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদেরও যুক্ত করা যেতে পারে। কারা নির্বাচন কমিশনে আসতে পারবেন আর পারবেন না, সে বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকারী কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আপত্তি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের চাকরি থেকে অবসর, পদত্যাগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ বা চুক্তি বাতিলের পর তিন বছর না পেরোলে তিনি নির্বাচন কমিশনের কোনো দায়িত্বে আসতে পারবেন না বলে শর্ত রয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, এই প্রস্তাবের আলোকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে তা নয়। এই প্রস্তাবকে ভিত্তি ধরে অন্য রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে যোগ-বিয়োগ করে একটি সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। তবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাবকে অন্তসারশূন্য বলে আওয়ামী লীগ নেতারা উড়িয়ে দেয়ার পরও আশা হারাচ্ছে না দলটির নেতারা। পর্যবেক্ষণ করছেন শেষ পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন গঠন হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনীতিতে কৌশল পাল্টাবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে ফের রাজপথের আন্দোলনের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তারা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ