শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্যারিস সম্মেলন ও ফিলিস্তিন সংকট

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : গত দু’শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও জঘন্য হলো- ইহুদিবাদীদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনী ভূখন্ড  দখলের ঘটনা। এ বিষয়ে ফরাসি গবেষক রুযে গারুদির মন্তব্য বেশ স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই ইহুদিবাদের উৎপত্তি। ইহুদিবাদীরা তাদের অবৈধ লক্ষ্য হাসিল করতে ইহুদি ধর্মকে অপব্যবহার করছে।’ মূলত ইহুদিবাদীরা গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনী জাতির ওপর চরম দুঃখ-দুর্দশা চাপিয়ে দিয়েছে। সেখানে চালানো হচ্ছে জাতিগত নিধনযজ্ঞ। ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে এমন একটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই সংকটের গভীরে নিক্ষেপ করেছে। যা থেকে উত্তরণ ঘটানো আজও সম্ভব হয়নি।
ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকেই অগ্নিগর্ভ ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ইহুদীরা ফিলিস্তিনীর উপর নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা চালানো হলেও তা কখনো ফলবতী হয়নি। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে ফিলিস্তিনী-ইসরাইল শান্তিচুক্তি এবং ফলশ্রুতিতে  উভয় শীর্ষনেতা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও শান্তিটা এখন পর্যন্ত অধরায় রয়ে গেছে। কিন্তু তা অধিকৃত ভূখন্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়নি।
সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন। ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এ সম্মেলনে। উদ্দেশ্য, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান। সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দুই পক্ষের কারোই একতরফাভাবে এমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়; যাতে ভবিষ্যৎ আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত  হয়। এই সম্মেলনকে ফিলিস্তিন স্বাগত জানালেও ইসরাইল একে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মেলন বলে উল্লেখ করেছে। দেশটি বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এর ফল মানতে তেল আবিব বাধ্য নয়। ফলে শুরুতেই এই সম্মেলন কার্যকারিতা হারিয়েছে বলে করছেন আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল।
প্যারিস সম্মেলনকে শান্তি  প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গত ১৫ জানুয়ারি  অনুষ্ঠিত হয় একদিনের এ সম্মেলন। এক বিবৃতিতে সংঘাতের ইতি টানতে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। তবে তারা ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে  স্থানান্তরের ব্যাপারে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানের ব্যাপারে সমালোচনাস  থেকে দূরে থাকছেন। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা হলেও প্যারিস সম্মেলনে দুই দেশকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাদের অনুপস্থিতিতেই শুরু হয়েছে আলোচনা। যা সম্মেলনের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
তবে আলোচনার ফলাফল শুনতে দুই দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্মেলনের যৌথ ইশতেহারে স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাজ্য। ইসরাইলের বিরোধিতা এবং নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের আগ মুহূর্তে এ সম্মেলনের সময় নির্ধারণের ঘটনায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ব্রিটেন। ফলে পুরো সম্মেলনটিই নিষ্ফল হতে চলেছে।
এদিকে প্যারিস সম্মেলনের একদিন আগে ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস রাজধানী তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্পকে এ পরিকল্পনা ত্যাগের আহ্বান জানান তিনি। মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর  করা হলে চলমান শান্তি আলোচনা হুমকির মুখে পড়বে বলেও সতর্ক করেন ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট। গত ১৪ জানুয়ারি ভ্যাটিকানে ফিলিস্তিনী দূতাবাস উদ্বোধনের পর মাহমুদ আব্বাস বলেন, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেল আবিব থেকে দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও এমনটা এখনো ঘটেনি।
মূলত অবৈধ ও দখলদার ইসরাইলের কারণে গত ৬৬ বছর ধরে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই অশান্তি ও অনিরাপত্তার আগুনে জ্বলছে। এর জন্য সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলোর ক্ষমতালিপ্সাই প্রধান কারণ। মুসলিম বিশ্বের একেবারে কেন্দ্রে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে সুদূরপ্রসারী অশুভ লক্ষ্য কাজ করেছে, তা বোঝা যায় ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই। ঊনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে আধিপত্যের বলয় বাড়ানো নিয়ে তিন ইউরোপীয় দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তারা নানা অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। ফিলিস্তিনী ভূখন্ডের ওপরও তাদের লোলুপ দৃষ্টি ছিল। কারণ ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই ফিলিস্তিন। ভৌগোলিক দিক থেকে এটি একটি কৌশলগত অঞ্চল। সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শাসনামলে ফিলিস্তিন  নিজের উপনিবেশে পরিণত করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালায় ফ্রান্স।
ফ্রান্সের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি টের পেয়ে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেয় ব্রিটেন। এ পরিকল্পনার আওতায় সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। এরই আওতায় দখল হয়ে যায় কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ফিলিস্তিন। ওসমানীয় সাম্রাজ্য যখন ক্ষয়িষ্ণু তখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব চলছিল। এ অবস্থায় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন্মুখ পরিস্থিতি ইউরোপকে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। তাদের আধিপত্য বিস্তারের  জন্য দু’টি জিনিস প্রয়োজন ছিল। এক- মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের একাংশ নিয়ে গঠিত উসমানীয় সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা। দুই- টুকরো টুকরো ভূখন্ডে পাশ্চাত্যের স্বার্থ সংরক্ষণকারী পুতুল সরকার বসানো।
ওসমানীয় সামাজ্যের পতন ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাব ক্ষুন্ন করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৮৯৭ সালে থিয়োডর হার্জেল ও তার সহযোগীরা সুইজারল্যান্ডে এক সমাবেশের মাধ্যমে বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। হার্জেল পরবর্তীতে ইহুদিবাদের জনক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তার বড় লক্ষ্য। কোথায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, সে ইস্যু সামনে আসলে বিভিন্ন এলাকার নাম উত্থাপিত হয়। হার্জেল ফিলিস্তিন ইহুদিদের জন্য প্রথম রাষ্ট্র ও সরকার গঠনের পক্ষে ছিলেন।
ওসমানীয় সাম্রাজ্য হার্জেলের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজি না হওয়ায় হার্জেলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্রের মাঝেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে নয়া শক্তির সমীকরণের এক পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে। ইহুদিবাদের প্রতি ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের সমর্থন ফিলিস্তিন প্রথম ইহুদিবাদী সরকার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করে।
১৯১৭ সালে উপনিবেশবাদী ব্রিটেন ও বিশ্ব ইহুদিবাদের মধ্যে সম্পর্কের নয়া অধ্যায় শুরু হয়। ওই বছর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিস্তিন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। ১৯১৮ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসংঘ ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটেনের একাধিপত্যকে স্বীকৃতি দেয়। তিন দশক ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ছিল ফিলিস্তিন। তখন পর্যন্ত  ফিলিস্তিনের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময় ছিল এটি। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত  ব্রিটিশ শাসকরা ফিলিস্তিনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই তিন দশকে বিশ্ব ইহুদিবাদ সংস্থা ফিলিস্তিনে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত  থেকে ফিলিস্তিনের দিকে ইহুদিদের ঢল নামে। নানা দেশ থেকে তাদেরকে সেখানে নিয়ে আসা হয়। ফিলিস্তিনীদের জমি দখল করে ইহুদিবাদীদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। শক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনীদের ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়।
এ সময় ব্রিটিশ সরকারের মদদে ইহুদিবাদীরা গোপনে ‘হাগানা’ নামের সন্ত্রাসী সেনাদল গঠন করে। তারা নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যার মিশনে নামে। একের পর এক বহু ফিলিস্তিনী হত্যা করে। এ অবস্থায় পাশ্চাত্যের পুঁজিপতিরা ইহুদিবাদীদেরকে ব্যাপক অর্থ সাহায্য দেয়। এ অর্থে তারা ফিলিস্তিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কারখানা ও বিভিন্ন ইহুদিবাদী দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে,যাতে সুযোগ এলেই ইহুদিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া যায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনকে ভাগ করার ইশতেহার প্রকাশ করে। এরই ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। এক অংশ দেয়া হয় ইহুদিবাদীদেরকে। সেখানে তারা ইহুদি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। অন্য অংশ দেয়া হয় ফিলিস্তিনীদেরকে।
ফিলিস্তিনী মুসলমানদের এ দুর্দশার মাঝে ইসলামি ও আরব দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও বিবাদ ছিল শতাব্দির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এই সুযোগে অবশেষে ১৯৪৮ মাসের মে মাসে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ বাহিনী চলে যায়। শুরু হয় ইহুদিবাদীদের দুঃশাসন। যা এখ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ফিলিস্তিন জবরদখলের দুই দশক পর ১৯৬৭ সালে ইহুদিবাদীরা আরব বিশ্বের ওপর ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। এ সময় ইহুদিবাদী ইসরাইল জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, পূর্ব বায়তুল মোকাদ্দাস, সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও মিশরের সিনাই মরুভূমি দখল করে নেয়। আরব ভূখন্ড দখলের পর এসব এলাকায় ইহুদি উপশহর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। জমি দখলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অবশিষ্ট বসতিগুলোকে একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করা হয়। এর ফলে ফিলিস্তিনীদের শহর ও গ্রামগুলো পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনীদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকার মাঝখানে ইহুদি উপশহর নির্মাণ করা হয়েছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিদেরকে নিয়ে আসার প্রবণতা আরো বেড়ে যায় এবং ফিলিস্তিনীদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সেখানে ইহুদি অভিবাসীদেরকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব হারিয়ে শরণার্থীতে পরিণত হয় অগণিত ফিলিস্তিনী।
ইসরাইলের এ ধরনের অমানবিক তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ দুটি ইশতেহার প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের ইশতেহারে ১৯৬৭ সালে দখলীকৃত ভূখন্ড  থেকে সরে আসতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ইসরাইল ওই দুই ইশতেহারকে কোন গুরুত্বই দেয়নি। এখনও তারা পুরোদমে ইহুদি বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ২০০২ সালে ইসরাইল ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণ করেছে। এ দেয়ালের উচ্চতা ছয় মিটার। এটি বর্ণবাদী দেয়াল নামেও পরিচিত। এই দেয়ালের মাধ্যমেও ফিলিস্তিন ভূখন্ডের আরো একটা অংশ নতুনকরে দখলে নিয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইল। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কোনো প্রতিবাদকেই¡ দিচ্ছে না ইসরাইল। গাজার ওপর ইহুদিবাদীদের সর্বাত্মক অবরোধও এখনও অব্যাহত রয়েছে।
ইসরাইলের অপকর্ম এখন গোটা বিশ্বের কাছেই সুস্পষ্ট। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রথম দিকে যারা ইসরাইল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন তারাই এখন এ কথা স্বীকার করছেন- ইসরাইল দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে এবং এটি ভেতর থেকেই ভেঙে পড়বে। যেসব ইহুদি ধোকায় পড়ে অন্য দেশ থেকে ইসরাইলে এসেছিল এখন তারা ইসরাইল ছাড়তে শুরু করেছে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ইসরাইলি রাজনীতিবিদদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতি ইসরাইলের পতনের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলে গণঅসন্তোষ বেড়ে গেছে। মাঝে মধ্যেই লাখ লাখ বঞ্চিত মানুষ রাজপথে মিছিলে অংশ নিচ্ছেন। এসব বিক্ষোভকারী বৈষম্য, দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারত্ব, আবাসন সংকট, নৈতিক স্খলন এবং পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। এই সেই ইসরাইল যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিদেরকে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল তাদের জন্য ভূস্বর্গ বানিয়ে দেয়া হবে। এসব ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে ইসরাইলে আনা হলেও এখন উল্টো চিত্রটিই চোখে পড়ছে।
সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদে এরইমধ্যে ১৪ জন বিক্ষোভকারী নিজের শরীরে নিজেই আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ১৪ জন আত্মহত্যাকারীর প্রথম ব্যক্তি ছিলেন মুশে সালমান। শরীরে আগুন দেয়ার কয়েক দিন পর তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। তিনি নিজের শরীরে আগুন দেয়ার আগে এক বার্তায় বলেন, ইসরাইলি নেতারা হলো চোর। তারা মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করেছে। সাধারণ মানুষের কথা তারা ভাবে না।
ইসরাইলের গণঅন্তোষের পাশাপাশি আবার ভূখন্ডকে দখলদার মুক্ত ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ আন্দোলনও উত্তরোত্তর শানিত হচ্ছে।  চিরবৈরী হামাস ও ফাতাহর মধ্যে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনে ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য সরকার গঠনে রাজি হয়েছে দেশটির দুই বৃহৎ দল। তিন দিনব্যাপী আলোচনার পর  রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, সংগঠন দুটি একটি জাতীয় পর্ষদ গঠন করবে, যার সদস্য হবে নির্বাসিত ফিলিস্তিনীরাও। সেই পর্ষদ নির্বাচন আয়োজন করবে। দুই দলের চুক্তিতে ফিলিস্তিনে সক্রিয় সংগঠন ইসলামিক জিহাদকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে কোনা ধরনের দরকষাকষিতে রাখা হয়নি সংগঠনটিকে। ২০০৬ সালের আইনসভা নির্বাচনে জয়ী হয় হামাস। এর পর ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকার শাসনক্ষমতা দলটির হাতে। সে সময় থেকে ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহর সঙ্গে দলটির বিরোধ চলছিল।
এ বিরোধের মধ্যেই গত বছর অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ১০ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রথম পৌরসভা নির্বাচন বন্ধ করে দেয় সরকার। ফিলিস্তিনের হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়, ফাতাহনিয়ন্ত্রিত পশ্চিম তীরেই পৌর নির্বাচন হওয়া উচিত। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল, যাতে অংশ নিয়েছিল হামাস ও ফাতাহ। মস্কোতে সমঝোতায় পৌঁছানোর আগে ফিলিস্তিনের একটি প্রতিনিধিদল রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভের সঙ্গে দেখা করে। প্রতিনিধিদলটি ইসরায়েলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে যাতে না আনা হয়, সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝাতে লাভরভের প্রতি আহ্বান জানায়।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্মমতা ও বর্বরতা বাড়ছে, ক্রমেই প্রতিরোধ আন্দোলনও ততই শানিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনীরা ছোটখাট উপদলীয় কোন্দল ভুলে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। সাম্প্রতি হামাস-ফাতাহ ঐক্য সে প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এর মধ্যেই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হয়ে গেল মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এ আলোচনা থেকে কোন ইতিবাচক ফল আশা করা খুব সহজসাধ্য হচ্ছে না। মূলত ফিলিস্তিনীদের ভাগ্যের নির্ধারণ ফিলিস্তিনীদেরই করছে হবে। কোন আলোচনায় অতীতে যেমান ফলদায়ক হয়নি, আর কখনো হবে এমন আশা করা খুব একটি যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। তাই ফিলিস্তিনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আবরতের ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও বিশ্বমুসলিমের ঐক্যবদ্ধ জরুরি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ