ক্ষমতা মমতার মিলনেই শাসন নিরাপদ হয়
অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান : ক্ষমতা আর মমতা দু’টি শব্দ সকলেরই পরিচিত। সূর্যের তাপ ‘ক্ষমতা’ আর চন্দ্রের কোমল স্নিগ্ধ শীতল পরশ ‘মমতা’ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলে। বাঁচতে হলে উষ্ণতা যেমন প্রয়োজন শীতলতারও তেমনি প্রয়োজন। গরম ও ঠা-ার সমন্বয়ে পৃথিবী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হয়। দিনের আলো ও রাতের অন্ধকারের বিবর্তন আমাদের জন্য কল্যাণকর ও সুখকর। সতরাং পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে, ক্ষমতা আর মততার মহামিলনের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের বিজয় সাধন করতে হবে। এখানেই শেষ নয় জাতি, ধর্ম, বর্ণের ও মতের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও স্রষ্টা সার্বজনীনভাবে আস্তিক ও নাস্তিকদের সমভাবে আলো, অন্ধকার,অগুন, পানি, বাতাস, পাহাড়, সাগর, নদী ও মাটির নীচের-উপরের বিভিন্ন উপাদান সমহারে ইনসাফপূর্ণ বণ্টনে প্রতিষ্ঠিত করে আসছেন। এসব নিয়ামত সকলেই ফ্রি স্টাইলে উপভোগ করে থাকে। পাশাপশি এসব উপাদান অফুরন্ত এমন কি মেয়াদও উত্তীর্ণ হয় না। উন্মুক্ত আকাশে, বিস্তীর্ণ জনপদে অথৈ সাগরে আল্লাহর চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউ নেই। নিশ্বয়ই তিনিই সমস্ত বস্তুর উপর ক্ষমতাবান । তিনি এসব সুবিন্যাস, বিবর্তন, পরিচালনায় কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি একক, তার কোন অংশীদার নেই। তিনি চিরঞ্জীব-চিরস্থায়ী অবিনশ্বর এবং রাহ্মানুর রাহিম তো বটেই। তারই পছন্দে যৎকিঞ্চিত সাময়িক ক্ষমতার দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে মানব জাতিকে প্রেরণ করা হয়েছে। ইচ্ছা, চিন্তা,বিবেক, বুদ্ধি ও কর্মের সাময়িক স্বাধীনতা দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়। পথ প্রদর্শক হিসেবে ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাযিল করা হয়, তন্মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এতে আছে সব সমস্যার সমাধান। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি এবং মৃত্যুর পর পরকালীন জীবনের অবস্থা কি হবে তা আগামভাবে পরিস্কার সতর্ক করা হয়েছে। যারা এ পথ নির্দেশ মেনে চলবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত বা চিরস্থায়ী শান্তির স্থান। যারা এর বিপরীতে জীবন পরিচালনা করবে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম বা শাস্তির স্থান।
এক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও পরকালীন কল্যাণ লাভের বিশ্বনেতা হলেন-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) । তিনি বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। তার নবুয়তী জীবন মাত্র ২৩ বছর হলেও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনসহ সকল ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জন্য মডেল তিনি। আদর্শ নৈতিকতার যত প্রকার গুণাবলী দরকার তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তিনি। তাঁর জীবন চরিত আমাদের নিকট চির অমলিন, চিরভাস্কর বটে। তার রাজ্য শাসন পদ্ধতি অতুলনীয়।
কালের বিবর্তনে পৃথিবীর মানচিত্র বিভাজিত হয়েছে, যুগে যুগে বহু দেশের জন্ম হয়েছে, বহু নেতার আবির্ভাব হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদল আর রাজনৈতিক পটভূমির বিবর্তনে নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। বহু নামীদামী ক্ষমতাধর ক্ষণজন্মা ব্যক্তির ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবার কারও কারও কলংকজনক ইতিহাস কালো কালিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাদের সে সব ইতিহাসকে বাদ দিয়ে বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবিদরা পথ চললে অনভিজ্ঞতার দায় বহন করতে হবে। এজন্য রাজনীতি যারা করেন তাদের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া খুবই যুক্তিযুক্ত। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা বিহীন রাজনীতি করা এমন যে, চলমান বৈমানিকের মাথায় অন্ত্র ঠেকিয়ে বিমান দখল করা সহজ হলেও যাত্রিবাহী বিমানকে নিরাপদে যথাস্থানে অবতরণ করা সম্ভব নয়।
এবার ক্ষমতার কথা বলা যাক, আমরা যদি সূর্যের তাপকে ক্ষমতা বলে মনে করি এবং এই ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করি তাহলে কী দাঁড়ায়। সূর্যের স্বাভাবিক ও গতানুগতিক তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে কর্দমাক্ত মাটি ফেটে চৌচির হবে, ফসলী জমি পুরে ছারখার হবে, সবুজ শ্যামল চারণভূমি তামার মতো রঙ ধারণ করবে। পশু-পাখি এমনকি মানুষ খাদ্যের অভাবে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করবে। হতাশা নেমে আসবে সর্বমহলে, মেজাজ হবে রুক্ষ, বদমেজাজের চর্চা বেড়ে যাবে, ন্যায়বিচার বিলুপ্ত হবে, দেশে দেখা দিবে চরম অশান্তি আর হাহাকার। আর্থাৎ ক্ষমতার দাপটে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এর পরিণতি কি হতে পারে তা পাঠকের নিকট প্রশ্ন রইলো। আবার সূর্যের তাপ ক্ষমতা এতটাই ক্ষীণ হলো যে এক নাগারে ৩ মাস সূর্যের আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছালো না, তাতে কী হবে? সবুজ গাছপালা সাদা ফ্যাকাসে হয়ে উঠবে, ফলনশীল বৃক্ষে দানা হবে না। সূর্যের কিরণের অভাবে-পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এমন দুর্বল ক্ষীণ ক্ষমতা কারো কাম্য হতে পারে না। উপরোক্ত আলোচনায় সহজেই বুঝা গেল যে, একটি সুনির্দিষ্ট তাপ ও কিরণ মানব জীবনে খুবই প্রয়োজন। মাত্রাতিরিক্ত তাপ আর নিম্নমাত্রার তাপ দুটোই জনহিতকর নয়। এর ভারসাম্য থাকা বাঞ্ছনীয়।
জীবিকা আর জীবনের জন্য সূর্যের আলো ও তাপ যেমন অতীব জরুরী তেমনি রাতের জোৎস্নার আলোরও প্রয়োজন আছে। বলতে পারি সূর্যের আলোয় আলোকিত দিনকে “ক্ষমতা” আর রাতের চন্দ্রের আলোকে “মমতা” মনে করি। তাহলেই বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে বৈকি। এই দুইয়ের কোনটা মাত্রাতিরিক্ত হলে অথবা হেরফের হলে সাধারণ জীবন যাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে। শেষ পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর।
উপরোল্লিখিত আলোচনার পর এবার আসুন আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার মাত্রা নিয়ে কথা বলি। এদেশে দু’ধরনের ক্ষমতা সাধারণত চিহ্নিত করা যায় এক ক্ষমতাসীন দল বা সরকারি দল অপরদিকে বিরোধীদল বা অক্ষমতাসীনদল। উভয় দলের কেন্দ্রবিন্দু তথা মিলনস্থল হলো জাতীয় সংসদ। আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় সংসদের গুরুত্ব অপরিসীম।
সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতায় গিয়ে সংখ্যা লঘুদের সাথে যেভাবে অগণতান্ত্রিক আচরণ শুরু করে, এতে তারা বাধ্য হয়ে সংসদ বর্জন শুরু করেন। যে উদ্দেশ্যে জনতা ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য জয়যুক্ত করেছিল তা ব্যাহত হয়। লাগাতার সংসদ বর্জন গণতন্ত্রের নীতির বিপরীতে জেনেও সংখ্যালঘু সংসদ সদস্যরা শুধুমাত্র নিজেদের পদ বহাল রাখার জন্য সংসদে যোগদান করে পদ বজায় রাখেন। এ ধরনের আচরণ দেশ ও জাতির জন্য শুভকর নয়।
এক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের মমতার অভাব জনিত কারণেই সৃষ্ট সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকে, দেশে দেখা দেয় মারাত্মক অরাজকতা, অসহিষ্ণুতা, ফলে হামলা-মামলার কারণে বহু লোকের জীবনাবসান হয়। জাতির ললাটে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার।
ক্ষমতাসীন দলের লোকদের একথা মনে রাখতে হবে সংখ্যালঘু নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও এদেশের নাগরিকদের ভোটেই নির্বাচিত। এটা বুঝতে ভুল করলে গণতন্ত্রের অংকে মারাত্মক ভুল দেখা দেয়। অপরদিকে শুধুমাত্র সরকারি দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য, গণতান্ত্রিক পন্থা লংঘন করে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বনকরণ বিরোধী দলের মোটেও উচিত নয়। সরকার তথা ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ। দুটি দলের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সমঝোতা ও যৌথ, উন্নয়ন প্রচেষ্টা জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারে। যা দ্বারা দেশ সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে।
সংসদীয় পদ্ধতি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি শুধুমাত্র এদেশেই নয় পৃথিবীর বহু দেশে বিদ্যমান। তাদের যেমন ক্ষমতাসীন দল রয়েছে তেমনি বিরোদী দলও রয়েছে। তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক। সংসদের ভিতরে বাইরে, রাজপথে, সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে, রাজনৈতিক চর্চা ও কর্মকৌশল জাতীয় কল্যাণমুখী। সে সব দেশে দফায় দফায় অয়াক-আউট, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ, মারমুখী অবস্থান সর্বোপরি সংসদ বর্জনের রেওয়াজ নেই।
আর আমাদের দেশে একদল অন্যদলের কার্যকলাপ সমালোচনায় নাতিদীর্ঘ বক্তব্য, মহান জাতীয় সংসদের মূল্যবান সময় অপচয় হয় তা কে না জানে। যে সংসদে জাতীয় ভাগ্য নির্ধারণী গবেষণা, আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে সে সংসদ ভবন যদি শুধুমাত্র বিতর্কশালায় রূপান্তরিত হয় তাহলে ফলাফল হবে বুমেরাং।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন দল যে সকল ভালো ভালো জনহিতকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ শুরু করে তা পরবর্তী ক্ষমতাসীন দল সেই সব প্রকল্প বা কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়। যেমন-এরশাদ সরকারের ‘পথকলি’ স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, যা আবার এখন চালু হয়েছে। ‘চাষির বাড়ি বাগান বাড়ি’ বি.এন.পি জামায়াত সরকারের সফল প্রকল্পকে বন্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের অনেক জনকল্যাণকর প্রকল্প বন্ধ করায় জাতি নানাবিধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের ভালো ভালো কর্মপরিকল্পনাকে স্বাগত জানানো, সহযোগিতা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? বিরোধী দলকে দেখলে মনে হয় যেন সব কাজে সব কথায় বিরোধিতা করার জন্যই জনগণ তাদের জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য রায় দিয়েছে।
সব কাজে সব কথায় বিরোধিতা করার প্রবণতা অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বটে। হ্যাঁ জনগণের তথা জাতির অকল্যাণকর পদক্ষেপ, পরিকল্পনার বিরোধিতা করারও যেমন প্রয়োজন তেমনি বিরোধী দলে অবস্থান করায় সব কাজে বিরোধিতা করার প্রবণতা জনহিতকর নয় এবং এতে হিংসা ও প্রতিহিংসা রাজনীতি ত্বরান্বিত হয়ে জাতি বিভক্ত হয়ে যায়। তাই বলি ক্ষমতাসীন দল বনাম বিরোধী দল শব্দপ্রয়োগ না করে বরং ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী দল বললে আমার মতে বেশি মানানসই মনে হয়। এক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগ যেমন শ্রুতিমধুুর হয়, কর্মেও জনগণ তাই আশা করে।
কিন্তু বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন রকম। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তথা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনের অংশ গ্রহণ এবং সাধারণ পরিষদে ভাষণ, প্লানেট ৫০-৫০ চ্যম্পিয়ন ও এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির গৌরব শুধু প্রধানমন্ত্রীরই নয় বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও উজ্জ্বল করেছে।
তেমনি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪ তম অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে ১৯ সেণ্টেম্বর ২০১০ রোববার গভীর রাতে নিউইয়র্কে জে.এফ.কে বিমান বন্দরে অবতরণের পর ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সাথে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে যে অপ্রীতিকর ঘটনার অবতরণা করা হয়েছে তাতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি বরং ক্ষুণœ্ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত, অতিরঞ্জিত ও অনভিপ্রেত বটে।
আবার দেশে ক্ষশতাসীন সরকার থাকার পরও পিলখানার বর্বরচিত ঘটনার জন্য সরকারের সমালোচনা করাও গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার ও তথ্যাধিকার বটে । অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারের বেশি মমতা জনগণ মেনে নাও নিতে পারে। যেমন মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বিমান বন্দর স্থাপন করা সে জেলার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিহত করেছে। তেমনি দেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আল-কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক বিধি বা নীতি তথা উত্তরাধিকার বিষয়ে নির্ধারিত আইনের বিপরীতে সংশোধিত নীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা এ দেশের তৌহিদী জনতা এত সহজে মেনে নেয়নি। তেমনিভাবে সুন্দরবনের পার্শে রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র জনগণ মেনে নেবে কিনা তা পরিবেশ ও সময়ের ব্যাপার।
দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যাবতীয় অন্যায়-অবিচার দূর করে একটি শোষণহীন, বঞ্ছনাহীন, দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সকলেরই কাম্য। তাই বলি ক্ষমতার অপপ্রয়োগে যেন নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। অপরদিকে বিরোধী দলের বিরোধপূর্ণ মনোভাব পরিত্যাগ করে সরকারি দলের সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সকল প্রকার ভালো কাজে সহযোগিতা দান করা যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনি জনবিরোধী কর্মকাণ্ড সুধরিয়ে দেয়ার মানসিকতা নিয়ে বিরোধিতা করা ও সমালোচনা করা বিরোধী দলের জন্য অত্যাবশ্যক।
আগেই বলেছি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি করতে হয়। বাদশা আকবর নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু রাজ্যের শিক্ষিত গুণীজনের পরামর্শ নিয়ে রাজ্য শাসন করতেন। গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণকারীদের বেশিদিন ক্ষমতায় রাখে না। একই রাষ্ট্রের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর শোষণ বঞ্ছনার শিকড় উপড়ে ফেলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার ইতিহাস বেশি দিনের নয়।
সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানদের জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে সে দেশের জনগণ মেনে নিতে পারেন নি। অতীতের ইতিহাস ও একই কথা বলে। ক্ষমতাসীন দলের একথা ভুললে চলবে না যে এদেশের গণতন্ত্রের চর্চা শবে বরাতের রুটির মতো। রুটি যিনি ভাজেন তিনি জ¦লন্ত আগুনের উপর প্রতিস্থাপিত তাওয়ায় রুটি দিয়ে উল্টিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। কারণ বেশী উত্তাপে রুটি পুড়ে যেতে পারে। ভাগ্য রজনীতে পোড়া রুটি কারো কাম্য নয়। এজন্য রুটিকে একবার এদিক একবার ওদিক উল্টায়, এতে করে রুটি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ভাজা হয় এবং দৃষ্টিনন্দন আকারে ফুলে উঠে। এটি এ দেশের জনগণের গণতন্ত্রের চর্চার নমুনা। অর্থাৎ এক বারের বেশী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা জনগণ এখন আর নিরাপদ মনে করে না। এই জন্যই রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাপদল হচ্ছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা পালা বদল নামক রুটিকে উল্টাতে উল্টাতে রুটির অবস্থা যখন বেশী খারাপ হবে তখন জনগণের নতুন রুটির প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য উভয় ক্ষমতাবান নীতি নির্ধারকদের আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, দুধ পান করা স্বাস্থের জন্য ভাল কিন্তু অতিরিক্ত গরম দুধ পান করা বা বরফের ন্যায় ঠা-া পানি পান করা কোনটাই জনগণের জন্য নিরাপদ বা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এক্ষেত্রে মধ্যম তাপমাত্রার পানির বা দুধ উভয়ই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
কাজেই ক্ষমতার দাপটে রাজ্য শাসন নয়, ক্ষমতা আর মমতার মহামিলনেই রাজ্য শাসন নিরাপদ ও টেকসই হয়। এতেই প্রকৃত গণতন্ত্র সুসংহত হয় এবং জনতার মানবাধিকার সভ্যতার বিজয় সাধন হয় ।
লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।