বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নজরুল হাকীমের কাব্যে স্বদেশ সমাজ এবং নারী

আবদুল হালীম খাঁ : নজরুল হাকীম সমাজ সচেতন একজন আধুনিক কবি। দীর্ঘদিন যাবত তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পদচারণা করছেন। সম্প্রতি তার দুটি কাব্য ও একটি কিশোর গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থ দুটি হচ্ছে-চেতনায় সমকাল এবং ছায়ার উপর ছায়া। চার ফর্মার দুটি কাব্যে মোট ৫টি কবিতা রয়েছে। এ কাব্য দুটি দিয়েই তিনি সুধী পাঠকদের প্রচুর প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছেন। কবি নজরুল হাকীম শিল্পের জন্য শিল্প নয় বরং মানবতার জন্য শিল্প এই তত্বে বিশ্বাসী। তার কবিতার মধ্যে দেশ, মানবতা, সমাজের অবক্ষয়, মানবচরিত্রের নানা দিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি অত্যন্ত শিল্প সুষমায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। গ্রন্থ দুটির অনেক কবিতায় তার সমাজ সমালোচক দৃষ্টি কাজ করেছে।
আমাদের এ সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মানুষের নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় নিখাদভাবে ফুটে উঠেছে। একেকটি কবিতা যেন একেকটি বিষয়ের স্বচ্ছ আয়না। তিনি সমাজকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বর্তমান দেশের অন্যায়, অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি, খুন, গুম, লুটপাট, সন্ত্রাস, বেকার, ভাসমান সমস্যা, ক্ষুধার্ত শিশু নরনারীর চিৎকার, ধর্ষিতা নারীর মর্মজ্বালা ও বুকফাটা আর্তনাদ অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ওঠে এসেছে তার কবিতায়।
কবি নজরুল হাকীম চাকরি উপলক্ষে শহরে অবস্থান করলেও তিনি একজন গ্রামের মানুষ। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার রয়েছে নাড়ীর টান। মানুষ শহর বা গ্রাম-গঞ্জের যেখানের অধিবাসী হোন, সবাই তার আপনজন-পরম আত্মীয়্ তিনি মানবতাবাদী। তাদের কষ্টের কথা তার কবিতার অনেক স্থান অধিকার করে আছে।
কবিতা তো একান্তই কবির হৃদয় নিঃসৃত বাণী-প্রাণের কথা।
কবির মানস প্রতিচ্ছবি। প্রকৃত কবিতা সমকাল ও সমাজের অম্লান দলিল। আধুনিক কোনো কবি বায়ুভুক আকাশচারী নন। নজরুল হাকীম মাটি মানুষের কবি। তার কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য তাতে অযথা কল্পনার ডালপালার বিস্তার নেই এবং অপ্রয়োজনীয় উপমা ও উৎপ্রেক্ষার আবর্জনা নেই। ভাষা তার নির্মেদ ও সাবলীল। ভাবগম্ভীর। মানুষ স্বদেশ, প্রকৃতি তার কবিতার উপাত্ত। কখনো কখনো প্রসঙ্গক্রমে আন্তর্জাতিক বিষয়ও তার কবিতায় ওঠে এসেছে।
আমাদের সমাজের পথে-ঘাটে চোখের সামনে পতীত, নিঃস্ব অসহায় মানুষের প্রতি কবির দরদ অপরিসীম। তার কবিতায় আঁকা একটি নিটোল ছবি :
বস্তির পাশে ক্ষুধার্ত এক শিশু
কাঁদছে ধুলায় লুটে
পাশে তার মা ভাঙছে ইট
টুকরো টুকরো স্তূপিকৃত ইটগুলো
যেনো মায়ের দুঃখের পাহাড়।
এই ক্ষুধার্ত কান্নারত শিশু ও তার মায়ের পাশে কবি আরেকটি দৃশ্য তুলে ধরেছেন:

বস্তির সম্মুখেই বহুতলা চাকচিক্য ভবন
দুতলার বারান্দায় এক মা
বাবু তার চায় না খেতে
নাছোড় মা, তবু ছাড়ে না
ভরা পেটে খাবেই বা কি করে
কুশলী মা খোঁজে তাই নানা ছল:
কা কা আয় আয়
আয় কাকাতুয়া
বাবুর দুধভাত নিয়ে যা
ছি: ছি: দ্যাখো দ্যাখো বাবু!
কী পচা ওই শিশু---
(ছায়ার উপর ছায়া, বস্তির পাশে ক্ষুধার্ত শিশু- পৃ.২৭)

পাশাপাশি বাস করা এক বস্তির এক শিশু ও তার মা এবং অন্যদিকে এক ধনাঢ্য পরিবারের এক শিশু ও তার মা। আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এ কোনো কল্পনা নয়। অতি বাস্তব চিত্র। এক শিশু খাবার না পেয়ে কাঁদছে, আরেক শিশু অতি খাবার অত্যাচারে বিরক্তি বোধ করছে। কেন এ অসম ব্যবধান কবির জিজ্ঞাসা। দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মজুদদারীরা সমাজে এ ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। দরিদ্র বেকার অসহায় ভাসমান মানুষ ক্ষুধায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অন্যদিকে ধনিক শ্রেণির ঘরে ঘরে খাদ্য উপচে পড়ছে। তারা বিলাসিতায় ভেসে চলছে।
কবিরা জাতির বিবেক। অসহায় মানুষের কণ্ঠস্বর। কবি নজরুল হাকীম এখানে বিবেকহীন অন্ধ মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমাদের দেশে দরিদ্র অসহায় ভাসমান বেকারদের সাহায্য সহযোগিতা দানের নামে দেশি-বিদেশি কিছু সাহায্য সংস্থা আছে। দারিদ্র্যতা বিমোচনের নামে তাদের চড়া সুদে ঋণ দিয়ে আরো দরিদ্র করে ফেলছে, দরিদ্রদের শরীরের রক্ত শোষণ করছে। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো ছিন্নমূলদের সাহায্যের ভড়ং করে শুধু মিডিয়ায় প্রচার করে দেশের মানুষকে জানায়।
কবি নজরুল হাকীম এই সকল ধোকাবাজদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন ‘চেতনায় সমকাল’ কাব্যের ‘এরই নাম সেবা’ কবিতায়। ছিন্নমূল ভাসমানদের সেবা করার জন্য দাতাপক্ষ হোটেল সোনারগাঁয় অনুষ্ঠান করে। সেখানে গায়ক নর্তকীদের দিয়ে জমজমাট নাচগানে আনন্দ স্ফুর্তি করা হয়। ভোজ অনুষ্ঠান হয়। যাদের উপলক্ষে সে অনুষ্ঠান তারা স্থান পায় না সেখানে। ব্যথাভরা কণ্ঠে তাই কবির জিজ্ঞেস : কোর্ট-টাই পরা/তোমাদের কাতারে দেখি না কেন অই মুখ/খোদার দুনিয়ায় ওরা ভবঘুরে/বুঝি ঠাঁই নেই/... তো বন্ধ করো এ মিথ্যে ঢং/পাশে বসাতে পারো না যাদের/ ধুলো ময়লা মলিন বদন বলে/তাদেরই তোমরা করবে সেবা?---  চেতনায় সমকাল, পৃ. ৫৭)
সাধারণত: মানুষ সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের বাইরের চাকচিক্য ও ফ্যাশনটাই দেখে। আসলে সেটা সমাজের সঠিক অবস্থা ও চিত্র নয়। সমাজচিত্র পড়ে থাকে ভেতরে? সেটা দেখেই বুঝা যায়, প্রকৃত স্বরূপ। সেখানেই মানবতা। সে দৃশ্য দেখার জন্য যে চোখের প্রয়োজন সেটাকে বলে ‘তৃতীয় নয়ন’। শিল্পী কবিদের রয়েছে সেই ‘তৃতীয় নয়ন’। কবি নজরুল হাকীম সেই তৃতীয় নয়ন দিয়ে দেখেছেন সমাজকে। তিনি ‘অম্লান প্রেম’ কবিতায়
এমন একটি দৃশ্য তুলে ধরেছেন : সেদিন শীতের সকালে। দেখেছি নগরীর এক কোণে/ আশির ঊর্ধ্বে বয়সের ভারে নতজান্ ুমাজা ভাঙা কুঁজো এক বুড়ো/ ঠক ঠক করে কাঁপছে/ পৌষের হিম শীতে/ পাশে বসা বুড়ি পরনে তার ছেঁড়া কাপড়/ এক আঁচলে নিজের দেহ ঢেকে/ আরেক আঁচলে জড়িয়ে রেখেছে স্বামীকে। ভালোবাসার পরম উষ্ণতায়। (ছায়ার উপর ছায়া পৃ-১৪)
এ আমাদের সমাজের দৃশ্য। এ দৃশ্যের মধ্যে কোনো কল্পনার রঙের প্রলেপ নেই।
স্বদেশে ও বিদেশে বিশ্বনেতা নামে খ্যাত ব্যক্তিদের দুর্নীতি অপকর্ম এ ধ্বংসাত্মক কূটনীতির কথাও কবি নজরুল হাকীম সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন : দ্যাখো আমেরিকার নির্লজ্জ কা-/ মোড়লীপনা করতে গিয়ে/ ইরাক সিরিয়া লিবিয়ায়/ আগুন লাগিয়ে করছে ভস্মীভূত/ আবার ওরাই বলে সাম্যের কথা/ ঢাক ঢোল পিটায় মানবতার।
(ছায়ার উপর ছায়া , পৃ. ৫৩)
নজরুল হাকীমের কবিতার অধিকাংশ স্থান জুড়ে আছে সমাজের অসহায় মানুষের দুঃখ দুর্দশা, হতাশা বঞ্চনা, নৈতিক অবক্ষয় ও নিচতাহীনতার কথা। তবু তিনি হতাশ নন, আশাবাদী এবং সুন্দর সমাজ দাড়ার স্বপ্ন দেখেন। আশা এবং ভালোবাসা তাঁর কবিতার প্রেরণা।
স্বদেশ সমাজ ও সকালকে দেখাও জানার জন্য কবিতার চেয়ে উত্তম আয়না আর নেই। নজরুল হাকীমের ছায়ার উপর ছায়া কাজের কয়েকটি কবিতা যেমনÑ ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ, ক্ষুধার্ত মানব, কালিহাতীর ঘটনা, সাম্প্রতিক, ক্ষমতার মোহ, ছোট হলেও মগজ বড়, হাত মিলাও, অভাব বলতে কিছু নেই, অতল দুঃখ যার এবং ‘চেতনায় সমকাল’ কাজের স্বপ্নের ডাক, সুন্দর অভিশাপ, চেতনায় সমকাল, কাল সন্ধ্যেয় এসো, রঙ্গ ভরা এই পৃথিবী, আমি নারী, রাজনীতির চাল, পুরুষ পড়ে গেছে, এ তন্ত্র সে তন্ত্র নয়, তেল মারে, দুষ্টের স্বর্গ, ইত্যাদি উল্লেখ করার মতো।
নজরুল হাকীমের কণ্ঠস্বর সমসাময়িক কবিদের থেকে পৃথক/ তাঁর কাব্য ভাষায়ও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। পাটক সহজেই তা অনুভব করতে পারেন। তা নানা রৈখিক বর্ণে রঙে ম-িত ও বিভূষিত। নারী ও প্রেম তাঁর কবিতার আরেক অনুষঙ্গ। চেতনায় সমকাল কাব্যে ‘আমি নারী’ কবিতাটি এক অসাধারণ সৃষ্টি। নারী রক্তে মাংসে পুরুষের তো হলেও তার রূপ সৌন্দর্য ও আকর্ষণ ক্ষমতা অতুলনীয়। ফুল, পাখি, চাঁদ, নদী ও হরিণের চঞ্চলতা নারীর উপমা। শুধু তাই নয়, জগতের যা কিছু সুন্দর, অপরূপ, অনুপম, মনোমুগ্ধকর সবই নারীর উপমার জন্য।
শিল্পীরা নারীর শরীর, নারীর হৃদয় নিয়ে রঙে রঙ মিশিয়ে ছবি আঁকেন, কবিরা নারী রূপের কল্পনা ছাড়া কবিতা লিখতে পারেন না। পাঠক নারী প্রেমহীন কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়তে চান না। জগতে সুন্দর মধুর যা কিছু আছে সবই যেনো নারীর জন্য, নারীর কারণে।
কবির ভাষা : আমি নারী শুভ্র সুন্দর/ পুতঃপবিত্র/ আমি মহিয়সী  আমি গরবিনী/ আমি ঝিমালে পৃথিবী ঝিমায়/ আমি হাসলে ফুল হাসে/ আমি হাসলে ধরনী হাসে/ আমি হাসলে আকাশ বাতাস হাসে/ আমি থেমে গেলে হিমালয়ের/ ছলছল ঝরনা যায় থেমে/ ... আমি নারী/ আমার রূপভরা যৌবন দেখে/ প্রেমিক পুরুষ আমার চরণে মাথা ঠুকে/ না পাওয়ার বেদনায় কাতরায়/
আমার কাজল আঁখি
আমার মেঘ কালো কেশ
আমার বুক
আমার নিতম্ব
আমার ভেজা রাঙা ঠোঁট
¯্রষ্টার সর্বোৎকৃষ্ট নিয়ামত পুরুষের জন্য।
এমনি আরো, অসংখ্য বিশেষণ দিয়ে ‘আমি নারী’ কবিতাটি লিখেছেন, না বলে নানা রূপরস গন্ধ বর্ণ রঙ মাধুর্য দিয়ে শিল্পিত হাতে নির্মাণ করেছেন বলতে হয়। শেষে কবি বলেছেন Ñ ‘নারী ফেরদৌসের ফুল’।
(চেতনায় সমকাল, আমি নারী, পৃ. ২৭)
কবিতার ভুবন স্বপ্নময় সুন্দর ও আনন্দের ভুবন/ এ ভুবনে প্রবেশ করলে সংসারের যাবতীয় অভাব, দুঃখ, শোক, হাতাশা, বঞ্চনা, ক্লান্তি মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। মন প্রাণ এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। কবিরা মানুষকে নব জীবন ও নতুন প্রাণের স্বপ্ন দেখান/ এবং হৃদয় কাননে ভালোবাসার গোলাপ ফোটান/ অবচেতন মনে চেতনা জাগিয়ে তোলেন/ সত্য মিথ্যা, ন্যায়, অন্যায় সুন্দর অসুন্দর এবং হক বাতিলের পার্থক্য দেখান। কবি নজরুল হাকীম সেই কাজটিই করেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে/ আধুনিক দুর্বোধ্য ও অশ্লীল কবিতার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে তাঁর সহজবোধ্য, রুচিশীল মার্জিত ভাষা ছন্দে মাধুর্যের কবিতাগুলো াঠকদের অবশ্যই ভালো লাগে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ