শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বছরজুড়ে আলোচনায় ছাত্রলীগ

সামছুল আরেফীন : বছর শেষ হওয়ার তিন দিন আগে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে গেলো কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ-কুমেক। এ সময় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তারও সপ্তাহ খানেক আগে একই কারণে বন্ধ হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ সময়ের মাঝে মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছাত্রাবাসের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির রুম থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি -বিদেশি অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার সাংবাদিক সম্মেলন করে এগুলো প্রদর্শন করেন। এ দিকে নিজেদের নেতাকর্মীদের নিয়োগের দাবী করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ। এতো গেলো ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কয়েকটি ঘটনা। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, খুন, অপহরণ, অস্ত্র প্রদর্শন, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বছরজুড়েই তোলপাড় সৃষ্টি করে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ। সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ তাদের একক দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, কখনো নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করতে হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সুপার মার্কেটে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিলেন ব্যবসায়ীরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, খুনোখুনিতেও পিছিয়ে নেই তারা।
ছাত্রলীগের হাত থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও রক্ষা পাচ্ছেন না। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছেন ছাত্রলীগের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা। এই গুণধর ছাত্রলীগ নেতার কথিত প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় অসহায় ছাত্রী খাদিজাকে দা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। তিনি এখনও ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন।
ছাত্রলীগের এমন নজিরবিহীন নৃশংসতা যে এবারই প্রথম ঘটেছে তা নয়। সরকারি মদদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখলে রেখে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো উৎখাত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের একটি হাতিয়ারের নাম ছাত্রলীগ। ফলে লেখাপড়া ও এর পরিবেশ কিংবা ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এ সংগঠনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ হচ্ছে- জবরদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এমনকি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ। নারীঘটিতসহ বহু অপকর্মের সাথে এ নেতাকর্মীরা জড়িত থাকলেও তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
ছাত্ররাজনীতির নামে এদের উচ্ছৃঙ্খলতা, সন্ত্রাস ও অরাজকতায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রশ্রয় দেয়ার ফলে হেন অপকর্ম নেই যার সাথে এ ছাত্রসংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই। এরা শুধু একজন শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে রাজপথে হত্যার উদ্দেশ্যে কোপায়নি, এর আগে অন্তঃসত্ত্বা মাকে গুলি পর্যন্ত করেছে। ফলে পেটের শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী যে এমসি কলেজ চত্বরে এ শিক্ষার্থীকে কোপানো হয়েছে, কয়েক বছর আগে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারিতে এ কলেজের অনন্যসুন্দর হোস্টেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে শুধু দেশের শিক্ষাঙ্গন নয়, সারা দেশেই ছাত্রলীগ একটি ত্রাসের সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
কুমেকে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষ:  ২৮ ডিসেম্বর কুমিল্লাা মেডিকেল কলেজে (কুমেক) আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে (নওশাদ-রাহাত) ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্য দফায় দফায় সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছে। আগের রাত হতে পরদিন সকাল পর্যন্ত দফায় দফায় কলেজ ক্যাম্পাসে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে কলেজ প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে।
জানা যায়, কলেজ ছাত্রলীগের রাহাত সমর্থিত ২২তম ব্যাচ এর ছাত্রলীগ কর্মী তারেক, জনি নেতৃত্বে ১০/১৫ জনের একটি গ্রুপ মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নওশাদ গ্রুপের ২৫তম ব্যাচ এর ছাত্রলীগ কর্মী রানা, রুবেল, হৃদয়কে ব্যাপক মারধর করে । এসময় উভয় গ্রুপে সংর্ঘষে জড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বুধবার সকালে নওশাদ গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মীরা রাহাত সমর্থিত কর্মীদের রুমের দরজা বাহিরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে ৩০৬ নাম্বার কক্ষে প্রবেশ করে কুমেকের মেডিসিন ক্লাবের সভাপতি শ্যামল, ছাত্রলীগ কর্মী আশিক ও খালেদকে ব্যাপক মারধর করে ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে।
ছাত্রলীগের বাধায় রাবির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ: গত ২৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের নামে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে নির্ধারিত চাকরির পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। সকাল ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকসহ পরীক্ষা কেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেয় তারা। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
সকাল সাড়ে ৮টায় ক্যাটালিস্ট ক্যাটাগরি, ১০টায় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও বিকেল ৩টায় গ্রন্থাগার সহকারীতে সর্বমোট ২৭টি পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। তবে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বাধায় কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সকালে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এসময় পরীক্ষা দিতে আসা বাহিরে অবস্থানকারীদের ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেকের আবার প্রবেশপত্র ছিঁড়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পাশাপাশি মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ, মতিহার থানা আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রো-ভিসি প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহানের বাসভবনে স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীরা পরিক্ষা বন্ধের হুমকি দেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাসময়ে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মতিহার থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রধান ফটক, বিনোদপুর ফটক, কাজলা ফটক ও স্টেশন বাজার এলাকায় তালা ঝুলিয়ে অবরোধ করে রাখে মহানগর আওয়ামী লীগ, বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও মহানগর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এসময় নেতা-কর্মীদের সাথে অবস্থান করছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ: গত ২১ ডিসেম্বর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাধারণ ছাত্র ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে ভিসিকে তালাবদ্ধ রেখে তার অফিসের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছে শাবি শিক্ষার্থীরা। তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নও করা হয়েছে। এর আগে শাবি শিক্ষার্থীরা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক কিছুক্ষণ অবরোধও করে রাখে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতে পারে না। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে সিন্ডিকেট কমিটির সভায় ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া শাবির তিন আবাসিক ছাত্র হলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
মুন্সীগঞ্জে ছাত্রলীগ সভাপতির কক্ষ থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার: ২৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছাত্রাবাসের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির রুম থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি -বিদেশি অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। তার আগের রাত ১টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ জনকে আটক করা হয়।
দুপুরে মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম এক সাংবাদিক সম্মেলন জানান, সরকারি হরগঙ্গা কলেজের জিয়া হলের ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর রুম থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ১টি কাঠের বাট যুক্ত পাইপ গান, ১টি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ড্যাম, ১টি এয়ার গান, ৩টি ম্যাগাজিন, ৮৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি,৩টি রাউন্ড থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি, ৪ রাউন্ড শর্টগানের কার্তুজ, পাইপগন তৈরি বিভিন্ন অংশ, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ৫টি বড় রামদা, ৩টি রামদা, ২টি ছোট চাকু এবং ৩৩ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়। এ সময় একটি খেলনা পিস্তলও উদ্ধার করা হয়। তিনি আরও জানান, ওই রুমটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিবির আহম্মেদের। দীর্ঘদিন ধরে নিবির আহম্মেদ কলেজের ভেতর থেকে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। 
ছাত্রলীগ নেতার নৃশংসার শিকার খাদিজা: সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে গত অক্টোবরে। তাকে  ঢাকায় এনে অস্ত্রোপচার করা হলেও তার বেঁচে থাকার বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছিলেন না চিকিৎসকরা। “সে যে অবস্থায় রয়েছে, এ অবস্থায় তার লাইফ স্টে করার সম্ভাবনা ৫ থেকে ১০ পারসেন্ট,” বলেন স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রেজাউস সাত্তার। তার আঘাত সম্পর্কে ডা. মির্জা নিজামউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তার অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন। তার মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে। মাথার খুলি ভেদ করে ব্রেইনে ইনজুরি হয়েছে।” তবে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে, হাসপাতাল থেকেও ছাড়া পায় খাদিজা। এখন চিকিৎসা চলছে সাভারের সিআরপিতে। তবে কবে নাগাদ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে তা নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা।
সিলেট এমসি কলেজে চাপাতির মতো ধারাল অস্ত্রের আঘাতের শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা। তাকে কুপিয়ে আহত করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম। বদরুলকে ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার তাকে আসামি করে সিলেটের শাহ পরাণ থানায় মামলা করেছেন খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস। বিশ্ববিদ‌্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেছে বদরুলকে। এ নিয়ে আদালতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত ৯: বেপরোয়া ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংঘর্ষ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের নিজেদের মধ্যে শতাধিক সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে। এতে ৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন চার শতাধিক। প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে অহরহ।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন ৫৫ জন। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রাণহানি হয়। এসব ঘটনায় বন্ধ হয়ে যায় অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৪ সালে সবচেয়ে উত্তাল সময় কাটায় ছাত্রলীগ। ওই বছরের আগস্টেই অর্ধশত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটায় তারা। সশস্ত্র সংঘর্ষ, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের সামনে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা, রেলস্টেশন ভাংচুরসহ নানা ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা এর হল বন্ধ করে দিতে হয়। আর এর তিন মাস আগে এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে ১৫টি হামলা-সংঘর্ষে নিহত হন দু’জন।
গত ২০ নভেম্বর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দিয়াজ গ্রুপের প্রধান দিয়াজ ইরফান চৌধুরী রহস্যজনকভাবে মারা যায়। এটি হত্যা না আত্মহত্যা পুলিশ তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও দিয়াজের পরিবার ও সতীর্থদের দাবি এটি হত্যাকাণ্ড। টেন্ডার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষ গ্রুপ দিয়াজকে হত্যা করে লাশ বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। তারা এ হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিপক্ষ গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে দিয়াজ যে আত্মহত্যা করেননি তার বেশ কিছু আলামত পেয়েছে পুলিশ। বিশেষ করে ময়নাতদন্তে দিয়াজের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থাকলেও পা ছিল খাটের সঙ্গে লাগানো। এ কারণে এটি আত্মহত্যা নয় বলেই বদ্ধমূল ধারণা দিয়াজের সহকর্মী ও পরিবারের। দিয়াজের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. খালিদ সাইফুল্লাহ নামে এক নেতা। আহত হন অন্তত ১০ জন। এরপর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের দিনই চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নগর ছাত্রলীগের এক নেতাসহ ৩ জন গুলিবিদ্ধ ও এক সাধারণ শিক্ষার্থী ককটেলের স্পিন্টারে আহত হন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে মাসে এ ধরনের সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আধিপত্য বিস্তার, ভর্তি-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, কমিটিতে কাক্সিক্ষত পদ না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এসব সংঘর্ষ হয়।
২৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে ঘুম থেকে তুলে ছাত্রলীগের এক নেতাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে সংগঠনটির অন্য গ্রুপের নেতাকর্মীরা। হামলার শিকার এএসএম আল সনেট হল শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আশংকাজনক অবস্থায় ওই নেতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রলীগ।
১৭ জুলাই ঘোষিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তত ২৩ জন বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার আসামি স্থান পান। ওই কমিটি গঠনের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও টানা পাঁচদিন অবরোধ করে রাখেন পদবঞ্চিত নেতারা। অবরোধের মধ্যে শাটল ট্রেনে হামলায় দুই রেলকর্মী আহত হন। ধারাবাহিক এ সংঘর্ষে প্রায় ৪০ রাউন্ডের মতো গুলিবিনিময় হয়। পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ শাটল ট্রেনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এবং পদবঞ্চিতদের আশ্বাস দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করায়।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় একটি ভুলকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির গাড়ি ভাংচুর করে তার বাসভবনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণিকাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয়ার পরেও এ হামলার পেছনে ছাত্রলীগের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কারণ রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
২৭ মে বরিশালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করিম। ২৯ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির দু’পক্ষের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন সংগঠনটির নগর কমিটির উপ-সম্পাদক নাসিম আহমেদ সোহেল। ২০ মার্চ ছাত্রলীগের বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মশাজান-নোয়াবাদের গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে তাসপিয়া প্রমি নামের পাঁচ মাসের এক শিশু নিহত হয়। ২১ মার্চ নোয়াখালী সরকারি কলেজের পুরনো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জেলা ছাত্রলীগের সদস্য সাইফুল ইসলাম ওয়াসিম, নোয়াখালী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ফজলুল হুদা রাজিব ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইয়াসিন। ১৯ জানুয়ারি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাদের কর্মকাণ্ডে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন।
ছাত্রলীগের দুই নেতার অস্ত্র-মহড়া: রাজধানীর গুলিস্তানে ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করার সময় দুই ছাত্রলীগ নেতার প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ার ছবি অক্টোবরের শেষ দিকে গণমাধ্যমে আসায় এ নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। এ দুই ছাত্রলীগ নেতা হলেন ঢাকা মহানগর দণি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন ও ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তারা গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকায় মহড়া দেন, সেগুলো অবৈধ। র‌্যাব-পুলিশের সামনেই এ দুই ছাত্রলীগ নেতা অস্ত্র দেখিয়ে হকারদের ভয় দেখান। কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়েন। যদিও পরে তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়ে গোলাম মোর্তোজা তার এক লেখায় বলেন, গত সাত আট বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সহায়তায়, শিক্ষাঙ্গনে একক দখল প্রতিষ্ঠা করেছে ছাত্রলীগ। অস্ত্র-চাপাতি-রামদা তাদের হাতে শোভনীয় হয়ে উঠেছে। নিজেরাই নিজেদের নেতাকর্মীদের আহত-হত্যা করছে নিয়মিত বিরতিতে। সারা দেশের মানুষ, শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ছাত্রলীগ রামদা-তলোয়ার-পিস্তল নিয়ে মেতে আছে হত্যাকাণ্ডে। দু’একবার শিবিরের সঙ্গে ছাড়া, এসব করছে তারা নিজেরা নিজেরাই। গত সাত বছরে ৫৫ টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন ভয় করে চলে। ছাত্রলীগের ইমেজ তাদের কাছে ভীতিকর। ছাত্রলীগ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অন্য ছাত্র সংগঠনকে ছাত্র রাজনীতি করতে দিচ্ছে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ