শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

‘জুলেখার মন’ মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র প্রথম কাব্যগ্রন্থ

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি ও গদ্য লেখক মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র (জন্ম ঃ ১ জানুয়ারী ১৯৩৩ ও মৃত্যু ঃ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩) জন্ম বর্তমান ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত নাওঘাট গ্রামে। ১৯৫৬ সালে তিনি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র সাহিত্য-সাময়িকী ‘মাহে নও’-এর সহ-সম্পাদক হিসাবে চাকুরী নেন এবং ১৯৬১ সাল পর্যন্ত উক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি মাসিক ‘পুবালী’ পত্রিকায় যোগ দেন। ‘পুবালী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে নাম ছাপা হতো এর মালিক-স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের। কিন্তু এর সম্পাদনার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্। তাঁর যোগ্য সম্পাদনায় ‘পুবালী’ একটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯৬৪ সালে তিনি ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর (পরবর্তীতে ‘দৈনিক বাংলা’) ফিচার-এডিটর হিসাবে যোগদান করে সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ‘নজরুল ইনিস্টিটিউট’ এর প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী পরিচালক হিসাবে ১৯৮৫-৯৫ পর্যন্ত চুক্তির ভিত্তিতে নয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। ‘নজরুল একাডেমী’র প্রতিষ্ঠার সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী লেখক হিসাবে মাহ্ফুজউল্লাহ্র অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কবি হিসাবে তাঁর প্রথম আবির্ভাব এবং বিশেষ পরিচিতি ঘটলেও পরবর্তীতে কাব্য রচনার পাশাপাশি আলোচনা-সমালোচনা-গবেষণামূলক লেখায় নিজেকে তিনি এত নিমগ্ন  রাখেন যে, একসময় তাঁর সাহিত্যিক পরিচিতি অধিকতর ব্যাপকতা পায়। তবে কাব্য-চর্চায় তিনি কখনো বিরতি দেননি। তাঁর সমগ্র সাহিত্য-কর্ম বিবেচনায় রেখে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তিনি মূলত ও প্রধানত কবি। একজন বড় মাপের সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি সমকালের একজন বহুল আলোচিত প্রতিভাবান কবি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকাঃ
কাব্য ঃ ১. জুলেখার মন (১৯৫৯), ২. অন্ধকারে একা (১৯৬৬), ৩. রক্তিম হৃদয় (১৯৭০), ৪. আপন ভুবনে (১৯৭৫), ৫. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র কাব্য-সম্ভার (১৯৮২), ৬. বৈরিতার হাতে বন্দী (১৯৯০), ৭. সময়ের বিমর্ষ দর্পণে (২০০৬), ৮. কবিতা সংগ্রহÑমোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ (২০০১)। কয়েকটি সুদীর্ঘ ও সংলাপধর্মী কবিতাসহ তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা প্রায় পাঁচশো। তাঁর রচিত গানের সংখ্যাও আড়াই শতাধিকÑযা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রকাশিত গদ্য গ্রন্থের সংখ্যা সাতাশটি। এছাড়া, তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘পা-ুর আকাশ’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্য আর একটি উপন্যাস ‘জীবন খাঁচার পাখী’, ‘সচিত্র স্বদেশ’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া, তিনি এক ডজনের উপর ছোটগল্প রচনা করেছেন যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তবে তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাস এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। উপরোক্ত গ্রন্থ তালিকা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাহ্ফুজউল্লাহ্র অবাধ বিচরণ ছিল।
অতি অল্প বয়সে লেখালেখি শুরু করে আমৃত্যু তিনি সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন ছিলেন। ছয় দশকের অধিককাল মাহ্ফুজউল্লাহ্ নিরলসভাবে সাহিত্য ও সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে গদ্য-পদ্য উভয় রূপ-রীতিতে বিপুল অবদান রেখে গেছেন। কলেজ ও বিশ্বাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই উভয় বাংলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা ছাপা হয়। পঞ্চাশের দশকেই কবি হিসাবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জুলেখার মন’ (১৯৫৯) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৫৩-১৯৫৯। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভাধর অগ্রজ কবি ফররুখ আহমদকে। যদিও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মাহফুজউল্লাহ্র কাব্য-প্রতিভার উন্মেষ ঘটে এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত তাঁর লেখা অনেক কবিতাই ইতঃপূর্বে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তবু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই বিদগ্ধ পাঠকের নিকট কবি হিসাবে তাঁর খ্যাতি বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ‘জুলেখার মন’ কাব্যগ্রন্থে প্রেম, ঐতিহ্য-চেতনা ও নিসর্গ-প্রীতি একত্রে প্রাণবন্ত রূপ লাভ করেছে। যেমনÑ
    “একটি মেয়ের চোখে দেখি আমি সমুদ্রের নীল,
    প্রতিদিন, প্রতি-সন্ধ্যা তার দু’টি চোখ যেন জ্বলেÑ
    যেমন আকাশে জাগে রূপালি রেখার ঝিল্মিল্;
    না-বলে অনেক কথা সেই মেয়ে দু’টি চোখে বলে।
    তা’র গায়ে কে মেখেছে লাবণ্যের গোলাবী-পরাগ!
    সে যেন ফুলের মতো হেসে ওঠে সবুজ সকালে
    তার মুখ-অবয়বে লাগেনি তো কলঙ্কের দাগ,
    ফুটন্ত পদ্মের মতো ফুটে আছে চিকন-মৃণালে।
    লাবণ্যময়ীর দেহে উচ্ছ্বসিত প্রথম যৌবনÑ
    তাকে পেয়ে ফিরে পাই ¯িœগ্ধ এই পৃথিবীর মন।”
     (একটি মেয়ের চোখে ঃ জুলেখার মন)
এখানে প্রেমের কথা আছে, একজন লাবণ্যবতী সুন্দরী, রমণীর বর্ণনা আছে। কিন্তু একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, যৌবনের প্রারম্ভে লেখা প্রেম-বিষয়ক কবিতার ভাব-ভাষা-বর্ণনা অত্যন্ত স্বচ্ছ, সুন্দর, আবেগময় ও রুচিশীল। তাঁর রচিত কোন কবিতায়ই শরীরী কামনা-বাসনা, যৌনতা, অশ্লীলতার লেশ মাত্র নেই, যেটা আধুনিক কবিতায় আজকাল প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। মাহ্ফুজউল্লাহ্র প্রেম হলো তাঁর হৃদয়ের গভীর অনুভূতিসঞ্জাত এক নির্মল আত্মিক উপলব্ধি। প্রেম ও প্রেয়সীর সৌন্দর্যকে তিনি সর্বদা প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে সমান্তরালভাবে দাঁড় করিয়েছেন। তাই নারীপ্রেমের মধ্যেও তিনি অনুক্ষণ প্রকৃতিপ্রেমের অনুধ্যান করেন। ফলে তাঁর প্রেমিক সত্তা বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যময় হয়ে উঠেছে। সমকালীন অনেক কবি থেকেই তিনি এক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা বজায় রেখেছেন।
ঐতিহ্য-প্রীতি মাহ্ফুজউল্লাহ্র একটি সহজাত বিষয়। চল্লিশের দশকে উপমহাদেশের মুসলমানগণ যখন ইংরাজদের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে লিপ্ত, তখন স্বকীয় আদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের গৌরবময় পরিচিতি উদ্ধারে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সৃজনশীল ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ এক প্রত্যয় ও আবেগানুভূতির সৃষ্টি হয়। কবি শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৫-১৯৬৪), জসীমউদ্দীন (১৯০৩-৭৬), বেনজীর আহমদ (১৯০৩-৯৩), সুফিয়া কামাল (১৯১১-৯৯), আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), তালিম হোসেন (১৯১৮-৯৯), মুফাখখারুল ইসলাম (১৯২১-২০০৭), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২), আব্দুর রশিদ খান (১৯২৪-) প্রমুখ সে বিশেষ যুগ-পরিবেশে জাতির স্বপ্ন-কল্পনাকে রূপায়িত করার প্রয়াস পান। এ বিশেষ যুগ-পরিবেশেই মাহ্ফুজউল্লাহ্র কবি-মানস পরিগঠিত। তাই ঐতিহ্য-প্রীতি তাঁর অনেকটা সহজাত।
‘জুলেখার মন’-এ ঐতিহ্য-চেতনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। ‘জুলেখা’ আল-কুরআনে উল্লেখিত এক বিশেষ চরিত্র। মিসরের শাসকÑপতœী জুলেখা মানবীয় কামনা-বাসনায় তাড়িত হয়ে ইউসুফ আ.-এর রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমদগ্ধচিত্তে তাঁর সান্নিধ্য কামনা করেছিলেন। কিন্তু গভীর নৈতিকবোধসম্পন্ন পূতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী ইউসুফ আ. তা অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত পুরা কাহিনী গ্রহণ না করলেও শুধুমাত্র ‘জুলেখা’ নামটি বেছে নিয়ে তিনি এক আধুনিক কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। এতে কবির ঐতিহ্যপ্রীতির প্রকাশ ঘটেছে। আল-কুরআনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ যে মুসলিম রচিত সাহিত্যের উপাদান হতে পারে, মাহফুজউল্লাহ্ তার চমৎকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। 
ফররুখ আহমদের অনুরাগী মাহ্ফুজউল্লাহ্ এক্ষেত্রে স্বভাবতই তাঁর পূর্বসূরীর দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত। তাঁর কবি-কল্পনা, শব্দ-চয়ন, রূপকল্প নির্মাণে এ প্রভাব অনেকটা লক্ষ্যযোগ্য। কিন্তু মাহ্ফুজউল্লাহ্ অনুকরণ-প্রয়াসী নন। কোন সৎ সৃজনশীল প্রতিভাই অনুকরণপ্রিয় নন। তিনি সর্বক্ষেত্রে তাঁর নিজস্বতা ও স্বকীয় প্রতিভার উন্মোচনে সতত আগ্রহী। ফররুখ আহমদের পথ ধরে তিনি চলতে চেয়েছেন, কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান মাহ্ফুজউল্লাহ্ চলার পথে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যম-িত পথ খুঁজে নিয়েছেন। পুঁথি-সাহিত্যের আখ্যান ও চরিত্র নিয়ে তিনি সম্পূর্ণ আধুনিক ভাব, ভাষা, রুচি ও আঙ্গিকে আধুনিক কবিতা নির্মাণ করেন। এটা তাঁর শক্তিমত্তার এবং সে অর্থে মৌলিকতারও পরিচয় বহন করে।
নিসর্গ-প্রীতি মাহ্ফুজউল্লাহ্র কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শেলী, কীটস্, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের মত মাহ্ফুজউল্লাহ্ প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্যে একান্ত মুগ্ধ। বাংলার মনোরম শ্যামল প্রকৃতি চিরদিন কবি-শিল্পীদেরকে আকর্ষণ করেছে। কালিদাস, চ-ীদাস, বিদ্যাপতি, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ এঁরা সকলেই প্রকৃতির কবি। তাঁদের কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা আছে, বিশেষভাবে প্রকৃতির সাথে একাত্মতা অনুভব করেছেন তাঁরা। মূলত সব কবি-শিল্পীই প্রকৃতি-প্রেমে মুগ্ধ এবং কম-বেশী সকলের কাব্য-কবিতায়ই প্রকৃতির বর্ণনা আছে। মাহ্ফুজউল্লাহ্ও সে রকম একজন নিসর্গপ্রেমী। তাঁর কবি-কল্পনা ও হৃদয়ের একান্ত অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে প্রকৃতিকে আশ্রয় করে। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্যের বর্ণনায় কবি সর্বদা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যেমনÑ
“অফুরন্ত বৃষ্টি চাই আজ।
গ্রীষ্মের দুপুরে ক্ষীণ-কন্ঠে বাজে কান্নার আওয়াজ
অফুরন্ত বৃষ্টি চাই আজ॥
আষাঢ়ে যেমন ছিল নতুন মেঘের অভিসার
এখন এখানে যদি ¯িœগ্ধ ছায়া তা’র
পাওয়া যেতো
অথবা, চঞ্চলা সেই শ্রাবণ-রাতের কোনো নদী
বয়ে যেতো যদিÑ
তা’হলে হৃদয় হতো আঙুরের রসে টুপ্টুপ
হঠাৎ আকাশ-প্রান্তে যদি বৃষ্টি নামে ঝুপ-ঝুপ!”
(বৃষ্টির জন্য ঃ জুলেখার মন)
“ঘুম নেই দু’চোখে আমার।
 এখন রাতের ছোঁয়া সময়ের পাখীর পালকে:
 মাঝে মাঝে ছায়া-অন্ধকারে
 আকাশে ছিটানো তারা-অবারিত তারার জৌলুস।”
(তারার প্রেম ঃ জুলেখার মন)
মাহ্ফুজউল্লাহ্ নিছক নিসর্গ-প্রীতির জন্যই প্রকৃতি-আশ্রয়ী হননি। তিনি প্রকৃতিকে অনেক কবিতায় প্রতীক হিসাবেও ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘বৃষ্টির জন্য’, ‘শিকার’ প্রভৃতি কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার লক্ষণীয়। ‘বৃষ্টির জন্য’ প্রার্থনার মাধ্যমে কবি গ্রীষ্মকে অশান্তির প্রতীক এবং বৃষ্টিকে শান্তির প্রতীকরূপে ব্যবহার করেছেন। মাহ্ফুজউল্লাহ্ প্রকৃতিকে প্রেয়সীর সমান্তরাল করে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর আরাধ্য নারীকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্যের মধ্যেই কবি তাঁর প্রেয়সীর অনুধ্যান করেন।কবির মনের আনন্দানুভূতি প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণ-সুষমায় নানাভাবে পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ‘জুলেখার মন’-এর নাম কবিতায় কবি বলেন ঃ
“দক্ষিণের বাতায়নে আসে ¯িœগ্ধ মালতীর ঘ্রাণ
 সুন্দরী জুলেখা জাগে একা রাত্রি-নৈশব্দের বুকে
 ঘুমের ঝরোকা তার খুলে দিয়ে চাঁদের আলোকে
 সারা রাত কান পেতে শোনে দূর অরণ্যের গান;
 যেখানে তারার ফুল গুচ্ছবদ্ধ রয়েছে অম্লান,
 দুধের মতন চাঁদ একাকীই জানালায় জ্বলেÑ
 আকাশ-সমুদ্র থেকে সে-ও যেন মৃদু কথা বলে
 জুলেখা শুনেছে আজ সেই দূর-চাঁদের আহ্বান।”
(জুলেখার মন ঃ জুলেখার মন)
‘জুলেখার মন’ মাহ্ফুজউল্লাহ্র প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং আমার ধারণা, এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবি-কর্মও বটে। এখানে তাঁর আবেগের প্রকাশ ও অনুভূতির প্রগাঢ়তা অন্যান্য কাব্য থেকে অধিক বাঙময়। ফলে ‘জুলেখার মন’ পাঠক-মনকে নিবিড়ভাবে আবিষ্ট করে। মাহ্ফুজউল্লাহ্ মূলত রোমান্টিক কবি। রোমান্টিক কবির স্বভাব-বৈশিষ্ট্য এ কাব্যে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত। ‘জুলেখার মন’ সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক আব্দুল হক বলেন ঃ “মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ বিশুদ্ধ গীতি-কবিতার শিল্পী। কবিতা ব্যক্তিগত অনুভব ও চিন্তার শিল্পসম্মত প্রকাশ, এই তো গীতি-কবিতার লক্ষণ। বিশুদ্ধ গীতি-কবিতা আপনাতেই সম্পূর্ণ; শিল্প-সুন্দর রূপ-সৃষ্টি তার লক্ষ্য, কোনো পার্থিব বা পরমার্থিক প্রয়োজন সাধন তার কাজ নয়। মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র কবিতা প্রেমের চেয়ে প্রকৃতিরই প্রাধান্য। ...তাঁর ভাষা ও ছন্দের পালিশ আছে। বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দেই তিনি কবিতা লিখেছেন, তবে অক্ষরবৃত্তই তার প্রিয়তম ছন্দ।...”(আব্দুল হক, সমকাল, আশ্বিন, ১৩৬৬)।
ডক্টর সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন ঃ “কবিতাকে মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ অনুভূতির জগতেই আবিষ্কার করেছেন। বাস্তব সেখানে যদিবা উপস্থিত হয়েছে, তা-ও রোমান্সের রসে সিক্ত ও পরিশুদ্ধ হয়ে। ‘জুলেখার মন’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- আধুনিকতার চোরাগলিতে হারিয়ে গেলেও মানুষের মন এখনো ঐশ্বর্যরিক্ত হয়নি। তাতে ¯েœহ, প্রেম, সৌন্দর্যবোধ, আদর্শনিষ্ঠা, ঐতিহ্য-প্রীতি আজও অনেক পরিমাণে ক্রিয়াশীল।...লেখক মূলত রোমান্টিক, আর তাঁর রোমান্টিক মন ইসলামী ঐতিহ্য ও জীবনাদর্শের দ্বারা কতকটা প্রভাবিত। পুঁথি-সাহিত্যের নব রূপায়ণের প্রচেষ্টায়, কাব্যের নামকরণে, তাঁর এ-বিশিষ্ট মানসিকতার পরিচয় মিলে। তবুও মাহ্ফুজউল্লাহ্ মূলত রোমান্টিক কবি; বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবিতা রচনায় তাঁরই কৃতিত্ব সমধিক। আর তাঁর রোমান্টিক মনের অবলম্বন প্রকৃতি, প্রেম ও সৌন্দর্যবোধ।...মাহ্ফুজউল্লাহ্র কাব্যে প্রকৃতিরই প্রাধান্য। এ প্রকৃতি তাঁর রোমান্টিক-মনের স্পর্শে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছে। চিত্রকল্প সৃষ্টিতে, উপমার প্রয়োগে ও সুষ্ঠু শব্দচয়নে এসব ক্ষেত্রে মাহ্ফুজউল্লাহ্র কৃতিত্ব কম নয়। ...মাহ্ফুজউল্লাহ্র কাব্যে ভাষা ও ছন্দের ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় রয়েছে প্রায় সর্বত্র।” (সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, পূবালী, মাঘ, ১৩৬৭)।
প্রফেসর মুহম্মদ আব্দুল হাই বলেন ঃ “পুঁথি-সাহিত্যের ধারার সঙ্গে তার কাহিনী, শব্দ-বিন্যাসরীতি এবং শব্দের বয়ন-কুশলতা তথা ফ্রিজোলজির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সেগুলো স্বীকরণ সাধন করে শালীন কাব্য-সাহিত্যে তার ব্যবহার করতে পারলে আমাদের একালের সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে নিঃসন্দেহে। সম্প্রতি প্রকাশিত মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র ‘জুলেখার মন’ (১৯৫৯) কাব্যটির কয়েকটি কবিতায় ফররুখ আহমদ-প্রদর্শিত পথে পুঁথি-সাহিত্যের বাক-বিন্যাসরীতি ও তাঁর স্বপ্ন-কল্পনার অনুবর্তন আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে...।” (মুহম্মদ আব্দুল হাই ঃ ‘ভাষা ও সাহিত্য’)।
বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য-সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান বলেন ঃ “তাঁর (মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্) কবিতায় পুঁথি-সাহিত্য-ধারার অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের ঐতিহ্য, শ্রেষ্ঠত্ব কাব্যের মাধ্যমে লালন করা তাঁর কবি-স্বভাবের অন্তর্গত। (সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত কবিতা সংকলন)।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তাঁর প্রতিভা ও শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। ‘জুলেখার মন’ বাংলা সাহিত্যে তাঁর এক উল্লেখযোগ্য অবদান। এতে কবি হিসাবে তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয় সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ