বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

আবুল আসাদ : উনিশ শ’ একাত্তর সালের ১ মার্চ থেকে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল ছয়দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্যে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে। তখনই প্রধানত; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক তরুণরা চালাচ্ছিল নির্ভয় ও দুর্বার সংগ্রাম স্বাধীনতার জন্যে। অসহযোগ আন্দোলনের দাবি ছিল, নির্বাচন বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে নিঃশর্তভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, যাতে দলটি ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে দেশ শাসন করতে পারে। পাশাপাশি তরুণরা সমস্ত পিছুটান ‘ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্যে আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করছিল।
একাত্তরের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব এবং পিপল্স পার্টির প্রধান ভুট্টো ও অন্যাদের মধ্যে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে যে আলোচনা চলেছে, তা কবমেশি সবারই জানা। কিন্তু এই সময় ছাত্র তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকটা খুব বেশি প্রচারিত নয়। এটাই আমার আজকের আলোচনার বিষয়, খুব সংক্ষেপে।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ’ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে একটা খোলা চিঠি প্রচার করে। তাতে বলা হয়: “পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন... পূর্ব বাংলায় কৃষক শ্রমিক প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব-বাংলার অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন। প্রয়োজন বোধে এ সরকারের কেন্দ্রীয় দফতর নিরপেক্ষ দেশে স্থানান্তর করুন।.... পূর্ব-বাংলার জাতীয় মুক্তি বাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।” তাদের শ্লোগান ছিলো: “পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-জিন্দাবাদ, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী ও তার দালালদের খতম করুন, গ্রাম শহরে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করুন।”১  ১৯১৭ সালের ৩ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ তার পল্টনের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবে বলা হয়: “এ সভা পাকিস্তানী ঔপনিবেশিদের কবল হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বাধীনবাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েমের শপথ গ্রহণ করিতেছে।” ২ এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ ‘স্বাধী সার্বভৌম বাংলাদেশ’ এর যে ঘোষণা ও কর্মসূচি প্রচার করে তার অংশ বিশেষ এই: “৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাঙলাদেশ’। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
“(১) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি সৃষ্টি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে।
(৩) বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক) বাঙলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।...
(খ) স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।” ৩
ইশতিহারটি প্রচারিত হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর নামে।
স্বাধীন সার্বভৌম শোষণমুক্ত বাংলাদেশের জাগ্রত লেখক শিল্পীদের মুখপত্র বলে কথিত ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ’ (দ্বিতীয় সংখ্যা) এ বলা হয়: “আমরা বাংলাদেশের জাগ্রত শিল্পী-সাহিত্যিকদের জাগ্রত বিবেক থেকে আজ এ ঘোষণাই করছি, বাঙালী আর মোহাচ্ছন্ন থাকবেন না। শোষণহীন, রোদনহীন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েম করে বাঙালী আজ নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবেই করবে। সাথে সাথে আমরা বাঙলাদেশের সকল রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি এ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছি যে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আমরা আপনাদের রূপ দেখতে চাইনে। বাঙলার স্বাধীনতার বিপক্ষে যে কোনোরূপ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে জনগণের হাত থেকে আপনাদের নিস্তার থাকবে না। ...স্বাধীন সার্বভৌম শোষণমুক্ত বাঙলাদেশ জিন্দাবাদ।... পরিষদ বৈঠক বর্জন করো, বাঙলাদেশ স্বাধীন করো।”৪
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তাদের ইশতিহারে বলা হয় : “পূর্ব বাংলার মাটি আজ রক্ত চায়। পূর্ব বাংলার কোটি কোটি মানুষ আজ স্বাধীনতার জন্য উন্মাদ হইয়া উঠিয়াছে। ... আমরা পূর্বেই বার বার বলিয়াছি যে, নির্বাচনের মাধ্যমে আপোসে বাংলার স্বাধীনতা আসিবে না-আসিবে না পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা সমগ্র জনতার মুক্তি। মুক্তির একমাত্র পথ সশস্ত্র বিপ্লব।..... তাই আজ এক মুহূর্ত দেরী করার সময় নাই। পূর্ব বাঙলার মাটি আজ রক্ত চায়। তাই পূর্ব বাঙলার কৃষক গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করো। শাসক গোষ্ঠীর হাত হইতে ক্ষমতা ছিনাইয়া লও। গ্রামে বাংলার স্বাধীনতার পতাকা উড়াইয়া দাও। মুক্ত এলাকা গঠন করো। .... আস, আমরা ঘোষণা করি, হুশিয়ার! পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে যাহারা বাধা প্রদান করিবে কিংবা যাহারা তাহাকে মাঝ পথে থামাইয়া দিতে চাহিবে তাহাদের আমরা কিছুতেই ক্ষমা করিব না, বরদাশত করিব না।’৫
ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে ৮ মার্চ (১৯৭১) তাদের এক প্রচারপত্রে বলে : ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে- ঘরে ঘরে আজ উড়ছে স্বাধীন বাঙলার পতাকা। .... : বাঙলার সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত স্বাধীনতাকামী ভাইবোনদের নিকট আমাদের আকুল আবেদন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বাঙলার প্রতিটি ঘরে ঘরে মাতৃভূমি বাঙলাকে স্বাধীন করার যে দুর্জয় প্রতিজ্ঞা গর্জে উঠেছে তাকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রেখে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গঠন করতে হবেই। এর প্রেক্ষিতে সর্বস্তরে ‘বাঙলা মুক্তিফ্রন্ট’ (Bengal Liberation Front) গঠন করুন, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে মুক্তিফৌজ গড়ে তুলুন আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে সঠিক গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলুন।’৬
পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। তাদের প্রচারপত্রে বলা হয় : ‘বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এখানে পৃথক ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন।.....
পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্টরা দীর্ঘকাল হইতেই বাঙালিসহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দাবি করিয়া আসিতেছে।.... ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি ও জনতার সংগ্রামের জোরে গণদুশমনদের ও উহাদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করিয়া এখানে জনগণের দাবি মতে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলা’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অগ্রসর করিয়া লইতে হইবে। ... এ জন্য পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, কল-কারখানায় সর্বত্র দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শক্তি নিয়া গড়িয়া তুলুন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী।...৭
ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের আহ্বান জানায় ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ। ছাত্র ইউনিয়ন প্রচারিত ‘শোষণমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের সংগ্রাম আরও দুর্বার করিয়া তুলুন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলা হয় : ‘অনেক ঘটনার ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাত কোটি জনতা আজ পূর্ব বাংলায় তাহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কায়েম করিতে চাহিতেছেন, চাহিতেছেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করিতে। এই জন্য জনগণ আজ অকুতোভয় জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছেন। ... আমাদের দেশ-মাতৃকার উপর হইতে বৃটিশ, আমেরিকা প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের যে কোনো শোষণ ও প্রভাব লুপ্ত হইবে, কৃষকদের উপর হইতে জোতদার মহাজনদের সামন্তবাদী শোষণ উচ্ছেদ হইবে, দেশের জনগণকে পুনরায় পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকালে নিষ্পেষিত হইতে হইবে না। সকল প্রকার শোষণমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলা কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া বর্তমান সংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লইবার আহ্বান আমরা জানাইতেছি।....৮
মাত্র কয়েকটা দৃষ্টান্ত উপরে উল্লেখ করা হলো, কাহিনী আরও আছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সাথেই পদদলিত হয় জনগণের রায়, গুঁড়ো হয়ে যায় আলোচনার গণতান্ত্রিক টেবিল। সমাপ্তি ঘটে স্বাধীনতাকামী অসহযোগ আন্দোলনের। সামনে এসে দাঁড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রাম। শুরু হয়ে যায় মুক্তির যুদ্ধ-স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৬৬৩-৬৬৫
২- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৬৬৬
৩-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৬৬৭-৬৬৮
৪-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৬৯৩-৬৯৪
৫-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৬৯৬
৬-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৭০৫-৭০৬
৭-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৭০৯-৭১১
৮-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খ-, পৃষ্ঠা : ৭৩৩-৭৩৪

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ