বিনম্র শ্রদ্ধায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করলো জাতি
স্টাফ রিপোর্টার : নানা কর্মসূচিসহ বিনম্র ফুলেল শ্রদ্ধায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করলো জাতি। জাতির আলোক বর্তিকাস্বরূপ এসব ব্যক্তিদের হারানোর শোক সাড়ে চার দশক পরও বিহ্বল করে তাদের পরিবারের সদস্যসহ দেশবাসীকে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে দেশের কৃতী সন্তানদের হত্যা করে। তারপর থেকে দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বুধবার সকালে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জলন, শোক র্যালি, শ্রদ্ধা নিবেদন, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান ও হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
সকালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ সাহানে কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মুনাজাত করা হয়। মিলাদ ও মুনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মহিউদ্দিন কাশেম। এতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাধারণ মুসল্লিগণ অংশগ্রহণ করেন।
ভোর থেকেই রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বাইরে মাজার রোড ও আশেপাশের এলাকা এবং বায়েরবাজার বধ্যভূমি এলাকায় জনতার ঢল নামে। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাজারো মানুষ ভিড় করেন বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে। সবার হাতে ছিল ফুলের তোড়া ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে লেখা কালো ব্যানার। এবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদদের স্মরণ করতে আসা সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখছেন একটি আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। তারা বলেন, দেশের প্রতি ত্যাগের মাধ্যমেই বড় হওয়া যায়, এটাই তারা শিখিয়ে গেছেন।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে এসে শহীদ পরিবারের সন্তানরা বলেন, এবার আর আক্ষেপ নয়, পেছনে তাকানো নয়, এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
জাতির পক্ষ থেকে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ বেদীর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। শহীদদের সম্মানে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
পরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া শহীদ স্তম্ভের পাদদেশে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এডভোকেট আফজাল হোসেনসহ দলীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর ভবনের সামনে রক্ষিত স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর স্মৃতিস্তম্ভ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দেয়া হয়। পরে একে একে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা, ঢাকার দুই মেয়র, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন।
সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
এর আগে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, দলের সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, দলের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানান।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শিশু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান।
এদিকে বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রায়ের বাজারের বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধেও সকালে মানুষের ঢল নামে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বধ্যভূমির আদলে মানব ভাস্কর্য রচনা করে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর।
বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন মিলনায়তনে এক সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্বে করেন এবং বক্তব্য দেন।
এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে-একাংশ) জাতীয় প্রেসক্লাবে পৃথক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে।