শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস

০১ ডিসেম্বর, আরটিএনএন : সম্প্রতি সময়ে নিঃসন্দেহে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বাংলাদেশ সীমান্ত চৌকির সন্নিকটে মংডু শহরের কাছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে।

ওই হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান শুরু করে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৩৪ জন নিহত হয়েছে। ২৩৪ জন রোহিঙ্গা বার্মা সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গা নারী। এছাড়াও, আনুমানিক ৩০,০০০ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

নিরীহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু সীমান্তে নজরদারী বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে প্রবেশের রোহিঙ্গাদের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। চলুন একনজরে দেখে নেয়া যায় রোহিঙ্গা কারা ও তাদের সংকট শুরুর পটভূমি এবং নিপীড়নের দীর্ঘ ইতিহাস।

 রোহিঙ্গাদের ইতিহাস 

 রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হল রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সরকারি হিসেব মতে, প্রায় আট লক্ষ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে। রোহিঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমার সরকার ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, রোহিঙ্গারা এই তালিকার অর্ন্তভুক্ত নয়। মিয়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হল বাংলাদেশী, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মায়ামারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।

সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভূত এই সংকর জাতি এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল।

রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে শুরু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। ১৯৪২ সালের মধ্য জানুয়ারির দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানি সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। এছাড়া আরাকানের স্থানীয় রাখাইনদের ( বৌদ্ধ মগদের) সঙ্গে এসব উদ্বাস্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু দাঙ্গাও হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের মে মাসে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের প্রস্তাব ছিল রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করে বুথিডং ও মংদৌ নামে দুটি শহরের একত্রীকরণ। এর দুই মাস পর রোহিঙ্গা মুসলিম নেতৃত্ব আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে। তখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বার্মা থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই স্বাধীনতার দাবি ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যায়। ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন বার্মার রাখাইন প্রদেশে মুসলিম সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের দমন করতে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ পরিচালনা করে। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের কারণে মিয়ানমারের মূল কেন্দ্র থেকে উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান অঞ্চল কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই সুযোগটি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো।

রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘ নিপীড়নের ইতিহাস 

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা হতে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য পরিচয় পত্র থাকাটা খ্বু জরুরি বিষয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র ইস্যু করে না, ফলে, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রোহিঙ্গারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।

মিয়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশিরা কোন সম্পত্তি ও ভূমি মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা, বিদেশি। তাই, রোহিঙ্গারা কোন ভূমি বা, স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে যেসকল ভূমিতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে, মিয়ানমার সরকার যেকোন মুহূর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।

মিয়ানমার সরকার আইনের মাধ্যমে রীতিমত অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরি করতে পারে না, সরকারি কোন দপ্তরে রোহিঙ্গা কোন সেবা পায় না, ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা গ্রহণ করতে পারে না, উপযোগ সেবার (বিদ্যুত, পানি, জ্বালানী) জন্য আবেদন করতে পারে না, স্বপরিচয়ে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। প্রায় ৮০% রোহিঙ্গা বাস্তবিক অর্থে অশিক্ষিত।

প্রায়ই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা নিপীড়ণের খবর পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারি জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে প্রাচীন কিছু মসজিদও আছে। অনেক রোহিঙ্গাদের ব্যবসায় দখল/বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ‘গ্যাটো' জাতীয় বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে ওরা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা এই গ্যাটোগুলোতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ও নিম্নমানের।

রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। এছাড়া দুটোর বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। এইসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের ‘গ্যাটো ব্যবস্থা' তালিকাভুক্ত নয়, ফলে, এদের জীবন ফোঁড়ার উপরে বিষ ঘা এর মত। এরা গ্যাটোগুলোতে থাকতে পারে না। 

আবার, গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মিয়ানমারের নাগরিক নয় ওরা। অবস্থাটা ওদের এমন যে, মিয়ানমার সরকার ওদের কোন অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এইসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা ঢুবে মারা গেছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো কম। রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মিয়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেফতার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মিয়ানমার সরকার।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ