শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সংগ্রাম ও সফলতার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

হাবীবুল ইসলাম সুমন : ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
চারশ বছরের প্রাচীন শহর রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগাসিটি। সেই শহরের গৌরবের অপর নাম মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৪৪ সালে ১লা এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ। আদর করে সবাই তাকে ‘ধনী’ নামে ডাকতো। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে ওঠেন মোহাম্মদ হানিফ। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার। মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার’র প্রিয়কন্যা ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সাথে বিয়ে দেন। এই দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। পুত্র আলহাজ্ব মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।
মোহাম্মদ হানিফ যৌবন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের  কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তাঁর জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যানধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল সজ্জন ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা “নগর পিতা” খ্যাত যিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নির্বাচিত একজন মেয়র। নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ঈমানদার ও ধার্মিক মুসলমান। একইসাথে ইসলামের মর্যাদা এবং দ্বীন প্রচারেও ছিলেন সোচ্চার। তিনি তার স্বপ্নপ্রিয় ঢাকা নগরীকে ইসলামী স্থাপত্যকলায় সাজিয়ে তুলতে সহায়তা করেছেন। যার সুবাদে মুসলিম প্রধান দেশের রাজধানীতে বিদেশি মেহমান কেউ নেমেই যেন বুঝতে পারেন তারা কোথায় এসেছেন। বুকে হাজারো স্বপ্ন থেকে তা বাস্তবে রূপায়নের জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি মুসলিম হলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর কাছে ছিলেন পরমপ্রিয়। দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিন অথবা অন্য কোনো উৎসবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। তার সহায়তায় অসংখ্য মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সংস্কার করা হয়।
মোহাম্মদ হানিফ ছাত্র অবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দেয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও তার পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পরিবারের পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের বাসায় অবস্থান নেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনি সব সময় চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন।
 মোহাম্মদ হানিফের সাথে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কোন দিন কমেনি বরং মুজিব পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয়দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয়দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০’র জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে তিনি রাজপথে সংগ্রামের প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তি তুল্য খ্যাতি এবং অগাধ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া ঢাকা ১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের মহান দায়িত্ব পালন করেন। সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর এই মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মত হানিফ ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলী বাতি স্থাপন, নগরের সৌন্দর্য বর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।
নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারী শিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এছাড়াও মহিলাদের মাতৃত্বকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশু পার্ক নির্মাণ ও পুরাতন পার্কগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা, এছাড়াও বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে গেছেন। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কষ্ট লাঘব করতে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।  তার আমলে তিলোত্তমা নগরী গড়ার লক্ষ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব ঢাকাবাসীর নিকট তারই নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হিসেবে এটাই তিনি কাজে প্রমাণ করে গেছেন।
১৯৯৬ এর মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘‘জনতার মঞ্চ” গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট  তৈরি করে এবং যার ফলশ্রুতিতে; ৯৬-এর ১২ জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার জন্য মোহাম্মদ হানিফের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১শে আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে তার প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোঁড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় ও অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
জনগণের কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। আর রাজনীতির উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিতে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬-এর ৮ ফেব্রুয়ারী মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্রিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে গত ২৮ নবেম্বর-০৬ দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। অবশেষে চির অবসান ঘটে তার কর্মময় রাজনৈতিক জীবনের।
আজ ২৮ নবেম্বর তার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির চরম দুঃসময়ে। যখন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ, তখন জননেতা হানিফের মতো আদর্শনিষ্ঠ, অকুতোভয় বিচক্ষণ নেতৃত্বের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ান নয়। দেশের রাজনীতিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। একজন সফল রাজনৈতিক এবং সকল গুণাবলীর অধিকারী সম্পন্ন মোহাম্মদ হানিফ তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : হাবীবুল ইসলাম সুমন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ