শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

হারিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর বাবা-মাকে ফিরে পেল চন্দন

এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) : যে বাড়িতে এতোদিন ছিলো শুনশান নীরবতা সেই বাড়িতে আজ মানুষের কোলাহল। সকাল থেকে বাড়ির আশপাশের স্বজনরা জড়ো হয়েছে কৃঞ্চের বাড়িতে। কারণ আজ তাদের খুশির দিন। ৫ বছর পূর্বে তার হারিয়ে যাওয়া আদরের সন্তান চন্দন আজ বাড়ি আসবে। সকাল থেকে ঘরের দরজায় বসে প্রহর গুনছেন মা রেখা দেবী। কিছুতেই যেন সময় যাচ্ছে না। কখন ঘরে আসবে তার বুকের মানিক। দুপুরে গড়িয়ে প্রায় বিকেল তখন বাড়ি এলো চন্দন। পুরো বাড়িতে বাঁধভাঙ্গা উল্লাস যেন থামছেই না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না রেখা। এই কান্না তো আনন্দের। যে ছেলেকে পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ৫ বছর পর আবার সেই ছেলে ফিরে এলো মায়ের শূন্য বুকে। হারিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর আপন ঠিকানা ফিরে পেল মিরসরাইয়ের চন্দন চন্দ্র নাথ (১৫) নামের এই কিশোর। গতকাল বুধবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে উপজেলার ১৫ নং ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ চন্দনকে তার পিতার কাছে তুলে দেন। সে এতদিন ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ এর চাইল্ড সেনসেটিভ প্রোকেটনশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) এর বরিশালের কোতোয়ালী থানার চাঁদমারী মাদরাসা রোডে অবস্থিত সেন্টারে ছিল।
তাকে হস্তানন্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমতিয়াজ এমকে ভূঁইয়া, ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি ফরিদুল হাসান টিপু, এনজিও সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের বরিশাল অফিসের সমাজকর্মী তৃপ্তি সাহা, ইউপি সদস্য আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া প্রমুখ।
জানা গেছে, ২০১২ সালে বাড়ির পাশে মন্দিরে পূজায় গিয়ে হারিয়ে যায় মিরসরাই উপজেলার মধ্যম ওয়াহেদপুর গ্রামের কৃঞ্চ চন্দ্র নাথের ছোট ছেলে চন্দন চন্দ্র নাথ। এর পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান মেলেনি। অগত্যা ছেলেকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কৃঞ্চ চন্দ্র নাথ। ৫ বছর পরে ছেলেকে ফিরে পাওয়ায় খুশিতে আত্মহারা স্বজনরা।
এনজিও সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের সমাজকর্মী তৃপ্তি সাহা বলেন, ৫ বছর পূর্বে বরিশালের লঞ্চঘাটে ঘোরাফেরা করতো চন্দন। আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে পথশিশুদের দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অন্য শিশুদের সাথে চন্দনও দুপুরে খাবার খেতে আসতো। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর সে আমাদের সেন্টারে নিয়মিত অবস্থান করতে থাকে। সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তিন মাস সে কথা বলতে পারেনি। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও সমাজকর্মীদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে। এভাবে কেটে যায় পাঁচটি বছর। তখন মা-বাবা, ঠিকানা কিছুই বলতে পারেনি। তারপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও আমরা তার ঠিকানা যোগাড় করতে পারিনি। তার বাড়ি ভোলা জেলায় বললে সেখানেও যাই। সম্প্রতি সে জানায় তার বাড়ি মিরসরাই থানার ওয়াহেদপুর গ্রামে।
আমরা তখন মিরসরাই থানার ওসি ইমতিয়াজ ভূঁইয়ার সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানাই। তিনি ওয়াহেদপুর ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজের ফোন নাম্বার দিলে তার সহযোগিতায় চন্দনের ভাই সজলের সাথে কথা বলে শনাক্ত করি। সজলের সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার পর চন্দনের স্মৃতি অনেকটাই ফিরে আসে। সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত জানায়। ওসি ও চেয়ারম্যানের আন্তরিক সহযোগিতায় পরিবারের হাতে চন্দনকে তুলে দিতে পেরে আমরা সত্যিই আনন্দিত। সে দীর্ঘ ৫ বছর আমাদের কাছে ছিলো। তাকে আমরা সন্তানের মতো লালন পালন করেছি।
চন্দনের বাবা কৃষ্ণ চন্দ্র নাথ বলেন, ২০১২ সালে রাতের বেলা বাড়ির পাশে পূজা মণ্ডপে গিয়ে হারিয়ে যায় আমার ছোট ছেলে চন্দন। তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার কোন হদিস না পেয়ে এক প্রকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলের শোকে মা রেখা রানী দেবী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ভগবানের আশীর্বাদে আমার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমরা ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’র সমাজকর্মী তৃপ্তি সাহাসহ সকল কর্মীরে কাছে কৃতজ্ঞ।
১৫নং ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ বলেন, অপরাজেয় বাংলাদেশের সমাজকর্মী তৃপ্তি সাহার কাছ থেকে মুঠোফোনে জানতে পারি মিরসরাই থেকে পাঁচ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া চন্দন নামে একটি কিশোর বরিশালে তাদের সেন্টারে রয়েছে। বিষয়টি সকল ইউপি সদস্যসহ স্থানীয়দের অবগত করি। পরে চন্দনের পরিবার যোগাযোগ করলে আজ তার বাবার হাতে চন্দনকে তুলে দিই।
মিরসরাই থানার ওসি ইমতিয়াজ ভূঁইয়া বলেন, পাঁচ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া চন্দনকে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অপরাজেয় বাংলাদেশ যে মহৎ কাজটি করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। গত কয়েকদিন পূর্বে সমাজকর্মী তৃপ্তি সাহা ফোন দিয়ে বিষয়টি অবগত করে। এরপর আমি তাকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে অবগত করলে তিনি খোঁজ খবর নিয়ে তাদেরকে নিখোঁজ কিশোরের পারিবারিক বৃত্তান্ত দেন। এরপর পরিবারের কাছে চন্দনকে তুলে দেয়া হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ