হুমায়ূন আহমেদ এর ‘চোখ’
এ কে আজাদ : ‘আজ বাদ আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মতি মিয়ার চোখ তুলে ফেলা হবে। চোখ তুলবে নবীনগরের ইদরিস। এ কাজ সে আগেও একবার করেছে।’- চমৎকার শুরু! না, বহমান প্রবন্ধের শুরু না। শুরু ‘চোখ’। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত লেখক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এর ছোট গল্প চোখ। অসম্ভব রকমের জনপ্রিয় একটি ছোট গল্প। ছোট গল্পের কথা উঠলেই মনের পাতায় ভেসে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ছোট গল্পের সংজ্ঞাÑ
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারই দু’চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা নাহি ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ,
অন্তরে অতৃপ্ত রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হ’য়েও হইল না শেষ।
কেউ কেউ বলেছেন যে, ছোট গল্প হলে জীবনের স্কেচ-সাদা কালো পেন্সিলের আঁচড়। না, এ কথার সাথে এক মত হতে পারলেন না হার্সেল ব্রিকেল। তিনি লিখলেন ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড টু দ্যা শর্ট স্টোরী। বললেন- পেন্সিলের সাদা কালো স্কেচ তো স্থতিশীল, গতিশীল নয়। আর ছোট গল্প তো স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। সাদা কালো নয়, এরও একটা রং আছে। সে কথারই প্রতিধ্বনি যেন হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প ‘চোখ’-এ।
চমৎকার নাটকীয় শুরু ‘চোখ তুলে ফেলা হবে’। কার চোখ তুলে ফেলা হবে? মতি মিয়ার। কেন? কি দোষ করেছে সে? যদি অপরাধ করেই থাকে তাহলে পুলিশে দেয়া হচ্ছে না কেন? আইন আদালত কি নেই? আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে কেন? আর শাস্তি যদি দিতেই হয় এমন অমানবিক চোখ তোলার শাস্তি কেন? তাকে এক ঘরে করে রাখা যেত, অর্থ দ- করা যেতে পারত, অথবা অন্য কোন শাস্তি। তাই বলে একেবারে চোখ তুলে নেয়া? কোথায় মানুষ? কোথায় মানবতা? এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় হুমায়ূনের ‘চোখ’। অনেক কিছু দেখেও নীরবে যেন সব সয়ে যায় চোখ। ‘চোখের নাম আরশি নগর, একে একে মনের খবর, সে তো কইয়া যাবে।’ চোখ তো অনেক কিছুই সয়ে যায়, যেতে হয়। আর যারা খেজুরের কাঁটা দিয়ে চোখ তোলার অত্যন্ত নির্মম মানসিকতা পোষণ করছেন তাদেরই বা চোখ কোথায়? যে চোখের প্রতি মানুষের আস্থা, সেই আইনের চোখ কি দেখছে? এ রকম চোখের প্রশ্ন উঠতেই থাকে। এই সব দিকগুলো বিশ্লেষণ করলে গল্পটির নামকরণ যে কেমন সার্থকতা লাভ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
গল্প বিশারদদের মতে ছোট গল্পের আকার এমন ছোট হওয়া উচিত যেন দশ থেকে বিশ মিনিটের মধ্যেই পড়ে শেষ করা যায়। সেদিক বিবেচনা করলে ‘চোখ’ গল্পটি সেই আকারের মধ্যেই থাকে। তবে পড়ার টাইম ডিউরেশনের চাইতে বড় যে ব্যাপারটি তা হলো- ছোট গল্প জীবনের পূর্ণ অবয়বকে ধারণ করে না। বরং জীবনের নানান ঘটনার মাঝে ছোট খাটো দুঃখ ব্যথাকে ধারণ করে। যদিও চোখ তুলে ফেলার বিষয়টি মানব জীবনের জন্য অকে বড় ঘটনা, তবুও এই একটা ঘটনাই এই গল্পটির মূল প্রতিপাদ্য বা চড়রহঃ ড়ভ ঠরবি বা দৃষ্টিকোণ। তবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণে গেলে- মতি মিয়ার বউ মর্জিনার স্বামীর ঘর ছাড়ার বিষয় এবং বাজারে অবস্থানের বিষয়টিকে নিয়ে সাহিত্য বোদ্ধারা প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কারণ ছোট গল্পের প্লট বা কার্যকরণ একটাই হওয়া বাঞ্চনীয় তবে গল্পকার কিন্তু মর্জিনার বিষয়টি কেবল মাত্র মতি মিয়ার অনুমান কাহিনী বা স্মৃতিচারণ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। এ যেন স্টোরি উইদিন দ্যা স্টোরি। তবে পাঠকদের পক্ষ থেকে একটা বিষয়ে প্রশ্ন তোলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে-‘বাড়ির সামনে এসে মনে হত এইবার বাড়িতে ঢুকে দেখবে, বাড়ি খালি। কেউ নেই। বৌ চলে গেছে গত বৈশাখ মাসে।’ মতি মিয়ার এমন ধারণ বা কল্পনা থেকে হঠাৎ করে কেন্দুয়ার বাজারে এসে হাসান আলীর হাতে ধরা পড়ার বিষয়টি যেন একটু ঘটনার পরম্পরায় খানিকটা ছেদ ঘটিয়েছে। তবে ছোট্ট একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্পকার তুলে এনেছেন সমাজের কিছু বাস্তব চিত্র। জীবনের মূল্যবোধের ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুতা লাভ করেছে এক চমৎকার বাণী চিত্র। মতি মিয়াকে একজন সাধারণ চোর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন গল্পকার। তবে তার সংসারে যে অভাবের পাহাড় জমে আছে জগদ্দল পাথরের মত তাকে সরানোর জন্য এগিয়ে আসছে না কেউ। ঘরে তার বউ বড় কষ্টে দিনাতিপাত করে। অভাবের তাড়নায় চুরি করতে গিয়ে যখন ধরা পড়ে জেলে গিয়েছে, তখন তার পরিবারের লোকজন অনাহারে দিনাতিপাত করেছে। কেউ ফিরেও তাকায়নি। উল্টো মধ্য রাত্রে তার বাড়িতে গিয়ে তার বউয়ের হাতে পান খেয়েছে মজায় মজায়। এমন কি পুলিশের লোকেরাও যেন তার বউয়ের হাতে পান খেতে মজা বোধ করেছে। পেটের জ্বালায় তার বউ নিজের সম্ভ্রমহানীর ভয়ও যেন ভুলে গিয়েছে। বাজারে নিয়েছে আশ্রয়। অথচ কেউ দেয়নি তার সম্ভ্রমের দাম। কিন্তু যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বউয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কেন্দুয়ার বাজারে গিয়েছে মতি, তখনই হাসান আলীরা বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্বল মতি মিয়ার উপরে। এমনকি তার চোখ তুলে নেয়ার প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে তারা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে শিক্ষিত ও ভদ্র শ্রেণীর লোকেরাও। অবসরপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মোবারক সাহেব এবং নয়াপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক তারাও এসে উৎসুক্যের সাথে সহাস্যে যোগ দিয়েছে এই চোখ তুলে নেয়ার মহোৎসবে (!)। কারও বিবেকে একবারও সায় দেয়নি যে, এই গরীব মতি মিয়ার এমনিই তো ঘরে খাবার নেই, তার উপরে আবার চোখ তুলে নিলে কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তার জীবন? কী ভয়াবহ দুর্বিষহ অবস্থা নেমে আসবে তার সংসারের অন্যান্য সদস্যদের জীবনে? তারা এতটাই মরিয়া যে থানা পুলিশের প্রতিও তাদের আস্থা নেই, আইন আদালতের তোয়াক্কা নেই। আবার থানা পুলিশ যাতে মতির চোখ তুলে নেয়ার অপরাধে কাউকে ফৌজদারী ঝামেলায় না ফেলে, তার জন্য তাদেরকে ম্যানেজ করার জন্য তারা মেম্বারকে পাঠিয়েছে থানায়, তারা এখন নিশ্চিন্ত। মতি মিয়ার চোখ তুলে নিলে আর কোন সমস্যা নেই। যে মতি মিয়ার চাল নেই, চুলো নেই, যার হাতে একটা চাকু কিংবা দা-ছুরি থাকে না, যে জ্যান্ত মানুষকে ধরে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে বেঁধে রাখতে পারে হাসান আলীর মত এক সপ্তাহের কেরোসিন তেল কিনতে অসামর্থ্য একাই এক লোক, তাকে জন্মের মত অন্ধ করতে, খেজুর কাঁটা দিয়ে চোখ তুলে নিতেই এত আয়োজন। জড় হয়েছে গেরামশুদ্ধ লোক, ভাড়া করে আনা হচ্ছে চোখ তোলায় একজন এক্সপার্ট নবীনগরের ইদরিসকে। মতি মিয়াকে ধরে নিয়ে এসে হাসান আলী যেন বিশাল এক বীরত্বের কাজ করেছে। এগারো বার এগারো রকমের গল্প সে তৈরি করেছে। অবাক হয়ে শুনেছে মতি মিয়াও। হাত-পা বাঁধা রক্তাক্ত মতি মিয়া যখন পানি খেতে চেয়েছে, ন্যূনতম মানবিক আচারণও করা হয়নি তার সাথে। তাকে ঘিরে পাড়ার সকল লোকে হো হো করে হেসেছে। জšুÍ জানোয়ারকে বেঁধে রেখে মানুষেরা যেমন হো হো করে হাসে, উল্লাস করে, মতি মিয়াকে ঘিরেও চলেছে তেমনি পাশবিক উল্লাস। এই পাশবিকতার কাছে সমাজ পরাজিত, আইন শৃঙ্খলাও যেন এই পাশবিকতার কাছেই পরাভূত!
সমাজের চরিত্র চিত্রায়ন করতে গিয়ে গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন Ñ
মারের চোটে মুমূর্ষু মতি মিয়া যখন পানি খেতে চাইলো, “হাসান আলী পানি বিষয়ে কোন মতামত দিল না। বিস্মিত হয়ে বললো- হারামজাদা কেমুন ঢঙে কথা কয় শুনছেন? তার চোখ তোলা হইব এইটা নিয়ে কোন চিন্তা নাই। ক্যাট ক্যাট কইরা কথা বলতাছে। কী আচানক বিষয়! ঐ হারামজাদা! তোর মনে ভয়-ডর নাই? মতি জবাব দিল না, থু করে থুতু ফেলল। থুতুর সঙ্গে রক্ত বের হয়ে এলো।”
“মতি নিজে ক্ষমা চাইলে হবে না। এতে এরা আরও রেগে যাবে। সে দুর্বল হলে সর্বনাশ! দুর্বলকে মানুষ দয়া করে না, ঘৃণা করে।”
“সারা শরীরে যন্ত্রণা, পিপাসায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির বদনা সামনে আছে। কিন্তু কেউ মুখে ঢেলে না দিলে খাবে কিভাবে? হেড মাস্টার সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- কিরে মতি সিগ্রেট খাবি? সবাই হো হো করে হেসে ফেলল।”
“চোখ দুটো কি আজ চলেই যাবে? মায়া মমতা দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন তার মত লোকের শাস্তি ছিল মাথা কামিয়ে গলায় জুতার মালা ঝোলানো। তারপর এলো ঠ্যাং ভাঙ্গা শাস্তি, ঠ্যাং ভেঙে লুলা করে দেওয়া। আর এখন চোখ তুলে দেয়া। খেজুর কাঁটা দিয়ে পুট করে চোখ বের করে আনা।”
উপরোক্ত উদ্ধৃতি গুলোই বলে দেয়- আমাদের সামাজিক অবস্থা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। মানবিক বিপর্যয়, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যপক অবনতি এবং সেই সাথে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের নৈতিক অবক্ষয় এবং দুর্নীতি অত্যন্ত ইঙ্গিময়তা পেয়েছে হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয় ছোট গল্প ‘চোখ’-এ। ছোট গল্পে উপদেশ থাকে না, তত্ত্ব থাকে না, কিন্তু ইঙ্গিতময়তা থাকে। হুমায়ূন আহমেদের স্বার্থকতা এখানেই যে, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমাজের অসঙ্গতিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করতে পেরেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পেরেছেন। তবে আশা ছাড়েননি গল্পকার। মতি মিয়ার মুখে তিনি শুনিয়েছেন আশার বাণীÑ “আজ এই যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে, এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে ঐ মেয়েটির মত! সে অবশ্যই শেষ মুহূর্তে ছুটে এসে বলবে- করেন কী? করেন কী! আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এই টুকু বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি! না জানি সে দেখতে কেমন? সেই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মত মমতামাখা হবে? যার চোখের দিকে তাকালে ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছা করে?”
এমনি মানবিক চেতনার আশা নিয়ে আকস্মিকভাবে গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আকস্মিক শুরু এবং আকস্মিক সমাপ্তির চমৎকারিত্ব দেখাতেও সক্ষম হয়েছেন গল্পকার! ছোট গল্পে যেমন নাটকীয়তা থাকা দরকার, তার পুরোটাই, যেন মুন্সিয়ানার সাথে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন গল্পকার! প্রতিটি বাক্যকেই অত্যন্ত সচেতনতার সাথে সন্নিবেশিত করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় হুমায়ূনের এই গল্পে। তবে কিছু ভুল ত্রুটি যে থাকবে না, তা তো আর হয় না। সমালোচকদের দৃষ্টিতে দু’একটা জায়গায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু সমস্যা প্রতিভাত হলেও, সামগ্রিকভাবে ‘চোখ’ একটি সার্থক ছোট গল্প হিসেবে বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। ‘চোখ’ গল্পের মূল দৃষ্টিকোণ, প্লট, চরিত্রায়ন, পরিচর্যা ও স্বরূপ উন্মোচনসহ প্রায় প্রতিটি অংশেই দক্ষতার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ। তাছাড়াও গল্পের আকার, অপ্রয়োজনীয় ভাষার পরিহার, সমাজ চিত্র ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন, নাটকীয়তা ও ইঙ্গিতবহ ভাষার ব্যবহার, আকস্মিক শুরু ও শেষ-ছোট গল্পের ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের সবগুলোকেই আমলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন গল্পকার। মানুষ ও মানবতার প্রতি একজন লেখকের যে দায়বদ্ধতা তার প্রতিও লক্ষ্য রেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। পরিশেষে বলা যায় যে, হুমায়ূন আহমেদ এর ‘চোখ’ ছোট গল্পের এক সার্থক রূপায়ণ।