কাজল
নারায়ণ চন্দ্র রায় : অজপাড়া গাঁয়ের এক দুখিনী মায়ের সন্তান কাজল। কাজল লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী। কোন পরীক্ষাতেই সে দ্বিতীয় হয়নি। ফার্স্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে প্রতিবার। এখানেই শেষ নয়, সে খেলাধুলাতেও সমান পারদর্শী। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সে সব সময় সেরা পুরস্কারটিই অর্জন করে। এ জন্য স্কুলের স্যারেরাও কাজলকে খুব আদর করে এবং ভালবাসে। কাজলরা পাঁচ ভাই-বোন। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা নিজ নিজ স্বামী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। বছরে ২/১ বার বাপের বাড়িতে এলেও কয়েকদিন বেড়ানোর পর আবার তারা স্বামীর বাড়ি চলে যায়। ৫ বোনের পর কাজলের জন্ম হলে ওর দাদিই কাজলের নাম রাখে সোহাগ। কাজল নামটি অধিক পরিচিত হওয়ার ফলে কাজলের দাদির দেয়া সোহাগ নামটি আলোর মুখে দেখেনি। তবে ওর দাদির বয়সী পাড়ার দাদিরা কাজলকে সোহাগ বলেই ডাকে। কাজলের মা-খালারা কাজলকে কাজল বলে ডাকে। কাজলের বন্ধুরাও কাজলকে কাজল বলে ডাকে। ওর বন্ধুরাও ওকে কাজল বলেই চিনে। সোহাগ নামটি ওদের কাছে একদম অচেনা। কাজলের নাম রাখার পেছনে একটা মজার ঘটনা আছে। ঘটনাটি হলো কাজলের মা প্রতিদিন ওর কপালে কালো টিপ এবং চোখে কাজল পরিয়ে দিতেন। ছেলের ওপর কারো নজর যাতে না পড়ে সে জন্য প্রতিদিন কাজলের চোখে এবং কপালে কালো টিপ এঁকে দেন কাজলের মা রাহেলা বেগম। সোহাগ নামটি কাজলের পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। কারণ কাজল যে স্কুলে পড়ে সে স্কুলের ভর্তি খাতায় কাজল নামটিই লেখা হয়েছে। স্কুলে ভর্তি করানোর সময় সোহাগ নামটি লেখার খুব ইচ্ছা ছিল কাজলের বাবা আক্কাস মিয়ার। কাজলের বাবা আক্কাস আলী কাজলের দাদির দেয়া সোহাগ নামটি বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়ে আসছিল। এক কথায় দুই কথায় কাজলের মা ও বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল স্কুলের স্যারদের সামনেই। কাজলের মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা আক্তার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করলেন। তিনি দু’জনকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কাজলের মা বলল, আপা ৫ মেয়ের পর আমার এই ছেলেটি হয়েছে। কাজল আমার অনেক আদরের। সাত মানিকের ধন। মানুষের নজর এড়াতে আমি আমার ছেলের কপালে সব সময় কাজলের টিপ এঁকে দেই। কাজলকে কখনও আমার চোখের আড়াল হতে দেই না। সব সময় চোখে চোখে রাখি। কাজল দেখতে শুনতে খুব সুন্দর। প্রধান শিক্ষিকা কাজলের কপালের বাম পাশে একটা টিপ দেখতে পেলেন। কাজলের বাবার ইচ্ছা কাজলের নাম সোহাগ রাখবে। কাজলের মায়ের ইচ্ছা কাজল রাখবে। প্রধান শিক্ষিকা কাজলের মায়ের বিষয়টি বুঝতে পারলেন এবং দু’জনকে শান্ত করে বললেন, আক্কাস ভাই শুনেন-আপনাদের ছেলের নাম স্কুলের খাতায় কাজলই থাক। আপনারা বাড়িতে বরং সবাই ওকে সোহাগ নামে ডাকবেন। এতে করে কাজল আর সোহাগ দু’নামই থাকবে।
শেষ পর্যন্ত কাজলের বাবা আক্কাস মিয়া প্রধান শিক্ষিকার কথায় রাজি হলেন।
কাজলের দাদি এক সময় দুনিয়া থেকে চলে গেল। কাজল দিন দিন বড় হতে লাগল। পাড়ার দাদিরাও এক এক করে চলে যেতে শুরু করল দুনিয়া থেকে। কাজল নামের আড়ালেই রয়েছে গেল সোহাগ নামটি। ফলে কাজলকে সোহাগ বলে ডাকার মত আর কেউ রইল না। কাজলের বাবা ছেলেকে মাঝে মধ্যে সোহাগ বলে ডাকলেও তা খুব একটা আলোর মুখে দেখেনি। এক সময় কাজল নামটিই সবার কাছে প্রিয় হয়ে গেল। আর এভাবেই কাজল হয়ে উঠল সবার মধ্যমণি।