বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ ক্রস ফায়ার কোন্ বর্ণ

জিবলু রহমান : [পাঁচ]
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে মুকুলের লাশ শনাক্ত করে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে এ দাবি করেন তার দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলাম ও চাচাত ভাই রহমত আলী। নিহতের বাবা আবুল কালাম আজাদের দাবি, তার ছেলের নাম মুকুল রানা। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিল। এ ব্যাপারে তখন থানায় জিডি করা হয়। আবুল কালাম আজাদের দাবি, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তার সন্তান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কিনা বলতে পারেন না। মুকুল রানারা তিন ভাইবোন। তার বাবা বলছেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মুকুল সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে যশোরে বসুন্দিয়া এলাকায় শ্বশুর বাড়ির কাছ থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাকে কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল সে। টিভিতে খবর দেখে তিনি ছেলের ব্যাপারে জানতে পারেন।
নিহত তরুণের সুরতহাল রিপোর্টে খিলগাঁও থানার এসআই আল মামুন নিহতের নাম শরিফুল উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা অভিভাবক ছাড়া এ নামে লাশের সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ ইলিয়াস মেহেদী। ফলে অজ্ঞাতনামা (২৫) হিসাবে লাশের সুরতহাল সম্পন্ন করে লাশ ঢামেকের মর্গে রাখা হয়। নিহতের দুলাভাই পরিচয় দিয়ে সাতক্ষীরা নিবাসী হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, নিহতের নাম শরিফুল নয়, মুকুল রানা। এ সময় তিনি মুকুলের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখান। যার নম্বর, ১৯৯৩৮৭১৮২৫৪০০০০৬৮। এতে মুকুলের পিতার নাম মোঃ আবুল কালাম আজাদ এবং মাতার নাম মোছাঃ ছকিনা লেখা হয়েছে। তার জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর।
 হেদায়েতুল বলেন, পত্রিকায় নিহত মুকুলের ছবি দেখে তারা সাতক্ষীরা থেকে ঢামেক হাসপাতালে এসেছেন। লাশ দেখে মুকুলকে চিনতে পেরেছেন। তিনি আরও জানান, মুকুল সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল সে।
সাতক্ষীরায় মুকুলের বাবার ছোট চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা রয়েছে। আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল না হওয়ায় এক বছর আগে সে ঢাকায় চলে আসে। তবে মুকুল ঢাকার উত্তরায় কোথায় থাকতো, কী করতো বা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কি না তা তিনি জানেন না বলে হেদায়েতুল সাংবাদিকদের জানান।
মুকুল রানার বাবা আবুল কালাম আজাদের দাবি, মুকুল রানা চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন। তিনি চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি যশোরের জগন্নাথপুরে বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীর নাম মৌহা আক্তার রিমি। বিয়ের পরে একবার সাতক্ষীরায় বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর আবার যশোরে শ্বশুরবাড়িতে যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যশোরের বসুন্দিয়া এলাকা থেকে তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার তিন চার দিন পর যশোর কোতোয়ালি থানায় মুকুল রানার শালা আমির হোসেন একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
আবুল কালাম আজাদের দাবি, স্কুল-কলেজের সনদে তার ছেলের নাম মুকুল রানা। স্থানীয় লোকজনও তাকে মুকুল রানা নামে চেনেন। তার বয়স ২৩ বছর। তিনি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দুই বছর ধরে পড়াশোনা বাদ দিয়েছেন। আবুল কালাম আজাদ বলেন, তার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। সেই পক্ষে মাসুদ রানা নামের এক ছেলে আছে। তিনি চিংড়ি ঘেরে কাজ করেন। দ্বিতীয় বউয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে বড়, মুকুল রানা। মেয়ের নাম শারমীন সুলতানা রিমি। রিমি সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক শ্রেণির ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবুল কালাম আজাদের দাবি, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নিহত শরিফুলের বোন রিমির দাবি, তার ভাই মুকুল খুব মেধাবী ছিলেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম ২১ জুন ২০১৬)
বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহুল ব্যবহৃত এই বক্তব্য মানবাধিকারকর্মীসহ সচেতন নাগরিকেরা বিশ্বাস করেন না। ক্রসফায়ারের কারণে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন আইন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এসব ঘটনায় অপরাধের বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, ২৪ ঘণ্টায় দ্বিতীয় যে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটল, এর সঙ্গে কারা আছেন, কার নির্দেশে এটি হলো-এগুলো নিয়ে পূর্ণ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ভাষ্য, অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে এসব জঙ্গির সহযোগীরাই তাদের হত্যা করছে।
মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, এসব সন্দেহভাজন অপরাধীকে ধরে বিচারে দিলে কোনো লাভ হতো না, কোনো সাক্ষী আসত না-এসব কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র যে নিজেই বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন, সে বার্তাই মানুষের কাছে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষও বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, দুই জঙ্গি তরুণকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি সন্দেহে অভিযুক্ত কয়েকজন বন্দুকযুদ্ধে মারা গেল। এভাবে মৃত্যু না ঘটিয়ে তাদের স্বীকারোক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে সুষ্ঠু বিচার করতে পারলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেত, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য উদ্ঘাটন করা ছিল পুলিশের প্রথম ও প্রধান কাজ। কিন্তু এভাবে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার ঘটনা প্রশ্ন ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে।
ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দের স্থান নেই। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ হলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলী চালাতে পারে। সেই পরিস্থিতি হয়েছে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা চায় জনগণ।
এখনকার মতো পরিকল্পিত বা গুপ্তহত্যা অতীতে ছিল না। আইনের শাসনে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পিত হত্যা করা হচ্ছে। অন্য ধর্মের মানুষের ওপর যেমন আঘাত করা হচ্ছে, তেমনি স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এসব হত্যার পেছনে যারা আছে বা যারা অভিযুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু এভাবে মেরে ফেলা বিবেকবান ও সচেতন কেউ সমর্থন করতে পারে না।
বিচার নিজস্ব গতিতে চলা উচিত। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি কিন্তু হয়েছে বিচারিক প্রক্রিয়ায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, বিডিআর হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাকারীদের অপরাধের বিচার কিন্তু সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। এসব বিচার করাও এমন কঠিন কাজ নয়।
প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহীতার বিচার চলতে পারে। আপাতত: বিশেষ কোনো আইনের প্রয়োজন নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ২০ জুন ২০১৬)
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধান কোনভাবেই কাজ করছে না। একজন মানুষকে রিমান্ডে নেয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। রিমান্ড মানে তো আদালতের কাস্টডি। সে তো বিচারাধীন। সেখান থেকে তাকে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নেয়া হলো আর ক্রসফায়ারের নামে গুলী করে মেরে ফেলা হলো। এটা অবিশ্বাস্য। বিশিষ্ট এই নাগরিক বলেন, আরেকটি বড় ব্যাপার হলো, যারা ক্রসফায়ারে নিহত হচ্ছে তাদেরকে ধরতে কত কষ্ট করতে হয়েছে।  [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ