বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

যুদ্ধের উস্কানি ভারতের গণমাধ্যমে

২৮ অক্টোবর, নয়াদিল্লি : ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল উরি সীমান্তে গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
তবে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। গত জুলাইয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী তরুণ নেতা বুরহান মুজাফফর ওয়ানিকে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। এতে কাশ্মীর পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর পর থেকেই পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। এসব ঘটনা নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে।
নিঃসন্দেহে ভারতের গণতন্ত্র পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ভারতে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কাও কম। দেশটিতে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
এ ছাড়া বেশির ভাগ ভারতীয় তাদের গণমাধ্যমকে অনেকটাই স্বাধীন বলে মনে করেন। অন্য দিকে একটি প্রবন্ধ লেখার কারণে পাকিস্তানের সাংবাদিক মাইরিল আল মেইদার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সে দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আল মেইদার ব্যাপারে অভিযোগ, তার লেখাটি পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিব্রত করেছে। এ ঘটনাকে ভারতীয় গণমাধ্যম খুব আগ্রহসহকারে পর্যবেক্ষণ করে। তারা মনে করেছিল আল মেইদার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশটির গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের একটি পদক্ষেপ।
কিন্তু ভারতের গণমাধ্যমগুলো এ আত্মতুষ্টি খুব স্বল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল। কেননা বিস্ময়করভাবে পাকিস্তানের সাংবাদিক মহল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আল মেইদার সমর্থনে সভা-সমাবেশ করতে থাকে। তাদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে যুগপথ আন্দোলন করে। এসবের ফলাফলও শিগগির পাওয়া যায়। আল মেইদার বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
গত মাসে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরি সীমান্ত ঘাঁটিতে অনুপ্রবেশকারীদের হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনার নিহতের বিষয়ে লিখে আসছিলেন আল মেইদা। তার লেখায় পাক-ভারত সীমান্ত সঙ্কট নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে স্নায়ু লড়াইয়ের বিষয়ে ইঙ্গিত করেন তিনি। ভারত সীমান্তে হামলা নিয়ে দেশটির সরকারের কার্যকলাপে নিরীক্ষণমূলক তেমন কোনো পর্যালোচনার আভাস পাওয়া যায়নি। অথচ ভারতের গণমাধ্যমে আগেভাগেই যুদ্ধের ডামাডোল বাজানোর প্রতিযোগিতা জোরেশোরে শুরু করে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সেনারা একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালান। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় প্রতিশোধ হিসেবে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানো হয়েছে।
এ ঘোষণার পরপরই ভারতের জনপ্রিয় কয়েকটি সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল এ হামলাকে লোক দেখানো এবং সরকারের স্থূল রাজনীতি বলে উল্লেখ করে সম্প্রচার করতে থাকে। চ্যানেলগুলোর কোনো কোনো উপস্থাপক প্রতিবেশী পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করে। একটি টিভি চ্যানেল নিউজ রুমের চারদিকে বড় বড় ফ্যাশ লাইটের আলোতে খেলনা জঙ্গি বিমান রেখে একটি প্রতীকী চলমান যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
উপস্থাপক ও আলোচকদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিনে যুদ্ধসামগ্রী ভেসে উঠছিল। আর সামনে বড় বড় মোচওয়ালা সামরিক বিশ্লেষকরা বলে চলেছেন, আমাদের সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে এমন শিক্ষা দেবে যা তারা কোনো দিন ভুলবে না। ভারতের গণমাধ্যমগুলোর এ ধরনের যুদ্ধাংদেহী দেশপ্রেমের ক্রুদ্ধ প্রতিযোগিতা গ্রহণযোগ্য নয়। এর সাথে দেশটির রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদীরা উদ্বেগজনকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিষয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি ভারতের প্রাচীন ও অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সরকার আমলের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদাম্বরমের একটি সাক্ষাৎকার এনডিটিভি গ্রহণ করে। এতে তিনি বলেন, তাদের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে পাকিস্তানে পাল্টা আক্রমণ চালানো হয়েছে।
বর্তমান মোদি সরকারের মতো ঘটা করে তা জাহির করা হয়নি। এ সময় হঠাৎ এনডিটিভি সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। টকশোটি উপস্থাপক অর্নব গোস্বামী আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, সরকারের সমালোচকদের গ্রেফতার করা উচিত।
এছাড়া ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মুম্বাইয়ে চলচিত্রে পাকিস্তানের অভিনয় শিল্পীদের বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। একটি গ্রুপ হুমকি দিয়ে বলেছে যে, বলিউডের রোমান্টিক চলচ্চিত্র ‘আয় দিন হায় মুশকিল’ যেসব সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হবে, সেগুলোতে হামলা চালানো হবে।
আগামী মাসে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। পরিচালক করন জোহরের পরিচালনায় এ চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পাকিস্তানের হার্টথ্রব নায়ক ফাওয়াদ খান। তবে করন তার দেশপ্রেম ব্যাখ্যা করে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, চলচ্চিত্রটি দুই দেশের মধ্যে চলমান সঙ্কট সৃষ্টির আগেই ধারণ করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে তিনি আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন না। এক ভাষ্যকার তার এ বিবৃতিকে আত্মপক্ষ সমর্থন বলে মন্তব্য করেছেন।
চিদাম্বরম বলেন, সরকারে সমালোচকদের গণমাধ্যম কেন এড়িয়ে যাচ্ছে? অনেকে এর জবাবে বলেছেন, বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর ওইসব প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা নিয়ে ব্যবসা করছে। ফলে সরকারি দলের সমালোচনা বা তাকে আক্রমণের ব্যাপারে তারা খুব সতর্ক ভূমিকা পালন করছে।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থানের কারণে ভিন্নমত পোষণকারীদের সমালোচনা বা পর্যালোচনার জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া স্বাধীন মত প্রকাশ দমনে এ অঞ্চলের উপনিবেশের দমনমূলক আইনগুলোও ভূমিকা রাখছে।
দেখা যাচ্ছে, এখনো অতি উৎসাহী হয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো নানা আলোচনা সম্প্রচার বা প্রকাশ করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানের যুদ্ধ নীতি অনুসরণের একটি সমাধান চান ভারতবাসী। সেই সাথে তারা একটি অধিকতর শক্তিশালী এবং আরো কার্যকর সরকার চান, যারা পরমত যৌথ করবেন এবং বিভিন্ন সমালোচনা আমলে নেবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ