গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদ নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ ভাঙচুর ॥ রাস্তা অবরোধ যান চলাচল বন্ধ
স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর গুলিস্তানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হকারদের সাথে পুলিশ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মচারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের হামলায় বেশ কয়েকজন দোকান কর্মচারী ও হকার আহত হয়। পরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে রাস্তা ও ফুটপাতে থাকা দুই শতাধিক দোকান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে কয়েক লাখ টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে হকাদের অভিযোগ। প্রতিবাদে হকাররা গুলিস্তানে রাস্তা অবরোধ করলে কিছু সময়ের জন্য ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। গোটা এলাকায় এ সময় আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবু সাঈদ ও মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের পাতাল মার্কেটে অভিযান চালায়। মার্কেটের ভিতরে হাঁটার রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর অভিযোগে কয়েকজন দোকান মালিককে অর্থ জরিমানা করেন আদালত। এ সময় পাতাল মার্কেটের সভাপতি হাজী আনোয়ার হোসেন ও তার লোকজন আদালতের কার্যক্রমে বাধা প্রদান করেন। উচ্ছেদ ও অর্থ জরিমানা নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে বাক বিত-ায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। উচ্ছেদ কাজে বাঁধা দেয়ার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজী আনোয়ারকে আটক করে নগর ভবনে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মাকের্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আটক সভাপতির মুক্তির দাবিতে তারা পাতাল মার্কেট বন্ধ করে উপরের রাস্তা অবরোধ করেন। এ সময় দ্বীপন পরিবহনের দুটি বাস ভাংচুর করেন তারা। এরপর তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগর ভবনে যান। সেখানে নগর কার্যালয়ের প্রবেশ গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তারা। খবর পেয়ে মেয়র সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ও পুলিশ একযোগে দোকান কর্মচারীদের উপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। দোকান কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলী ছোড়ে। তাড়া খেয়ে দোকান কর্মচারীরা গুলিস্তানের দিকে যেতে থাকলে তাদের পিছু ধাওয়া করে কয়েকজনকে বেধড়ক পিটুনি দেয় পুলিশ ও কর্মচারীরা। এ সময় নগর ভবনে থাকা সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও ঠিকাদাররাও তাদের সাথে যোগ দেয়। দোকান কর্মচারীদের অনেকে ফুটপাত ও ওসমানি উদ্যানে আশ্রয় নিলে তাদেরকেও খুঁজে খুঁজে পিঠুনি দেয় তারা। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তোলা ও ভিডিও করার কাজেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
মেয়রের নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজার এলাকায় ব্যাপক শোডাউন দিয়ে আবার নগর ভবনে ফিরে আসে। মেয়র এ সময় বলেন, কিছু দুর্বৃত্ত নগর ভবনে ঢুকে বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, এ কারণে পুলিশ ও নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ধাওয়া দিয়েছে।
দুপুর আড়াইটার দিকে মেয়রের নির্দেশে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহম্মেদের নেতৃত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবু সাঈদ ও মোঃ মামুনুর রশীদ গুলিস্তান এলাকায় ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। এ সময় মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স মার্কেটের সামনের রাস্তা ও মহানগর নাট্যমঞ্চ সংশ্লিষ্ট গুলিস্তান পার্কের পশ্চিম পাশের প্রাচীর ঘেষে ফুটপাতে থাকা দুই শতাধিক দোকান পাঁচটি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। আচমকা এ অভিযানের আগে কোনো সময় না পাওয়ায় মালামাল সরাতে পারেননি হকাররা। এ কারণে তাদের অনেক মালামাল লুট ও নষ্ট হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বেলা দুইটার পর অভিযান শুরু হয়। তবে একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আধা ঘণ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
পল্টন থানার উপপরিদর্শক মো. বশিরুল বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের মতিঝিল বিভাগীয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।
জাহাঙ্গীর নামে এক হকার নেতা বলেন, সমস্যা হয়েছে পাতাল মার্কেটের লোকজনের সাথে, অথচ আমাদের উপর নির্যাতন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। হঠাৎ অভিযান চালানোয় অনেক মালামাল নষ্ট ও লুটপাট হয়ে গেছে। হকারদের পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানকালে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু আহমেদ মন্নাফী, হুমায়ুন কবির, মোঃ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ রতন, আনিসুর রহমান, ওমর বিন আব্দুল আজিজ, মোস্তবা জামান পপি ও তামিমের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা দফায় দফায় গুলিস্তানে শোডাউন করে। এ সময় লাঠিসোটা নিয়ে তারা হকারদের উপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় বেশকিছু হকার আহত হয়। এ সময় অভিযানের ছবি তোলায় কয়েকজন পথচারীও তাদের হাতে নিগৃহীত হয় ও তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। এ সময় হকাররা কয়েকদফা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মেয়রের নেতৃত্বে আবারো ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নেতাকর্মীরা গুলিস্তানে শোডাউন করেন। পরে গোলাপশাহ মাজার মোড়ে এক সমাবেশে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত রাখার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তিনি আরো বলেন, গুলিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এ পথ দিয়ে চলাচল করে। তাই এ এলাকার ফুটপথ পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিদিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাসহ যা যা করা দরকার সব করা হবে। অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকবে জানিয়ে মেয়র বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে নাগরিকদের অসুবিধা মেনে নেব না। উচ্ছৃঙ্খলভাবে কেউ রাস্তা দখল করতে চাইলে তাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে।
মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হকাররা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তবে পরিস্থিতি এখন শান্ত। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযান শেষে বিকেল চারটার দিকে নগর ভবনে জরুরি সংবাদ ব্রিফিং করেন ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনার আলোকে চলমান উচ্ছেদের অংশ হিসেবে আজ (গতকাল) গুলিস্তানে অভিযান চালায় ডিএসসিসি।
মেয়র বলেন, উচ্ছেদ অভিযানে হকারদের একটি অংশ বাধা দিয়েছিল। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে গুলিস্তানের সব অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাধা দেয়া প্রত্যেক হকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরবর্তীতে ডিএসসিসির উচ্ছেদ কার্যক্রমে কেউ বাধা দিলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। এ ছাড়া ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে ঢাকা মহানগর পুলিশকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।