শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

৯ মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১৫০

নাছির উদ্দিন শোয়েব : পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলীর পর কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর কথা বলা হলেও এসব ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হচ্ছে না। জঙ্গি, সন্ত্রাসী, ডাকাত, দস্যু ও অপরাধীদের পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক বা অপহরণের পর নিখোঁজ ব্যক্তিও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন। বন্দুকযুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য আহত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় পুলিশ-র‌্যাবের পক্ষ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ও ক্রসফায়ারে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। আসকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় র‌্যাবের চেয়ে এগিয়ে আছে পুলিশ। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৯ মাসে র‌্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৩৪ জন, পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৬১ জন, ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে ১১ জন, পুলিশ ও বিজিবি’র ক্রসফায়ারে ১ জন, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোয়াত টিমের অপারেশনে (হিট স্ট্রং-২৭) ৩ জন ও অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযানে ৯ জন, পুলিশের নির্যাতনে ৭ জন, ডিবি পুলিশের নির্যাতনে ১ জন, রেল পুলিশের নির্যাতনে ১ জন, পুলিশের গুলীতে ৯ জন, বিজিবি’র গুলীতে ১ জন ও থান্ডারবোল্ট অভিযানে যৌথ বাহিনীর গুলীতে ৬ জন মারা গেছেন। এছাড়া থানা হাজতে অসুস্থ হয়ে ৪ জন এবং ২ জনের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগের ভিত্তিতে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদা পোশাকে আসা ব্যক্তিরা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৭৫ জনকে আটক করে নিয়ে যান। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। তিনজন ফেরত আসলেও বাকি ১৮ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আটকের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গত নয় মাসে কারা হেফাজতেও ২৩ জন কয়েদি ও ৩৪ জন হাজতি মারা গেছেন। 

সম্প্রতি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা মামলার অনেক সন্দেহভাজন আসামী ‘বন্দুক যুদ্ধে’ কিংবা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হচ্ছে। এতে মূল ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আসামীর মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে মামলার তদন্ত কাজ যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের পার পেয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। 

নিহতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বলে জানায় পুলিশ। যারা লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা ও হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়াও রয়েছে, ডাকাত, সন্ত্রাসী, দস্যু, হত্যা মামলার আসামী। তবে নিহতের স্বজনদের দাবি নিহতদের পুলিশ আটক করে গুলী করে হত্যা করেছে। 

জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার ভোর পৌনে চারটার দিকে ঝিনাইদহে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে দুইজন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে পুলিশের দাবি। শহরের বাইপাস এলাকার শহীদ নজির উদ্দিন সড়কের মোড়ে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলী ও বোমা উদ্ধার করেছে পুলিশ। আহত পুলিশ কনস্টেবলরা হলেন- নাসিম, আলমগীর ও বুলবুল।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, ভোররাতে বাইপাস সড়ক দিয়ে কালীগঞ্জ থেকে তিনটি মোটরসাইকেলযোগে ৫/৬ জন সন্ত্রাসী বাস টার্মিনালের দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের একটি টহল দল তাদের থামতে সিগন্যাল দেয়। তারা তা অমান্য করে এগোতে থাকলে পুলিশ তাদের তাড়া করে। সন্ত্রাসীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে তিনটি বোমা নিক্ষেপ ও গুলীবর্ষণ করে। পুলিশও পাল্টা গুলী ছোড়ে। উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলীর পর সন্ত্রাসীরা দুটি মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় দুইজনকে উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। আহত তিন পুলিশ সদস্যকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি মোটর সাইকেল, দুটি ওয়ান শুটার গান, দুই রাউন্ড গুলী, পাঁচটি বোমা, দুটি চাপাতি ও একটি ছোরা উদ্ধার করেছে পুলিশ।

২২ অক্টোবর রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাসেল দেওয়ান (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান রাফিউর রহমান জানান, রাসেলের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র আইনে সাভার ও আশুলিয়া থানায় ১৪টি মামলা রয়েছে। তিনি এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী। রাসেল আশুলিয়া থানার নিরিবিলি এলাকার পিয়ার আলীর ছেলে। পুলিশের ভাষ্য, রাসেলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তলসহ কয়েকটি গুলী ও গুলীর খোসা উদ্ধার করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল রাসেলের। ছিলেন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরে তাঁকে দেখা যায় যুবলীগ পরিচয়ে। 

চুয়াডাঙ্গার স্কুলছাত্র সজিবকে অপহরণের পর হত্যা ও গুম মামলার আসামী সবুজ (২৮) ও শাকিল (২৪) র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ২২ অক্টোবর ভোর রাত পৌনে ৩টার দিকে দামুড়হুদা উপজেলার পরানপুর বেলেমাঠপাড়ার পাকা রাস্তার পুকুরের পাড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় র‌্যাবের ২ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে একটা দেশী শার্টারগান, একটি রিভলবার, চার রাউন্ড গুলী ও দুটি ধারালো হাসুয়া উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত সবুজ দামুড়হুদা উপজেলা শহরের মৃত হামিদুল ইসলামের ও শাকিল একই এলাকার আব্দুল কাদের মন্ডলের ছেলে।

১৭ অক্টোবর রাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতির চর রমিজ ইউনিয়নে দস্যু ফকির বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু নিহত হয়। নিহত মজনু উপজেলার চর আফজাল গ্রামের মৃত জাহাঙ্গীরের ছেলে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, অস্ত্র ও অপহরণসহ ১৪টি মামলা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রেফতার করার প্রায় ২৬ ঘণ্টা পর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানিক মিয়া (৩৬) নামের সন্দেহভাজন এক ডাকাত নিহত হয়। পুলিশ বলছে, মানিক মিয়া আন্তজেলা ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন। তিনি ‘হাতভাঙ্গা মাইনকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাত একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। মানিকের বাড়ি উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নে। 

৩০ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম নয়ন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। পুলিশ জানায়, তিনি হত্যাসহ একাধিক মামলা আসামী। নিহতের স্বজনদের দাবি, নয়ন বিএনপি করেন এবং পুলিশের দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় বন্দুকযুদ্ধের নাম করে তাকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। নিহত নয়ন সাভার পৌর এলাকার মালঞ্চ মহল্লার শহিদুল ইসলামের ছেলে। পুলিশের দাবি, সাভার মডেল থানায় মাদক, অস্ত্র ও ডাকাতি মামলাসহ ডজনখানেক মামলার আসামী শাহ আলম নয়নকে মোহাম্মদপুর থেকে আটক করা হয়। এরপর সাভার মডেল থানা পুলিশ তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে বের হয়। ভোররাতে বিরুলিয়া ইউনিয়নের কৃষিবিদ নামক এলাকায় পৌঁছলে পুলিশকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলী চালায়। এ সময় নয়ন সুযোগ বুঝে পালানোর চেষ্টা চালান। পরে পুলিশ পেছন থেকে গুলী ছুঁড়লে নয়ন গুলীবিদ্ধ হন। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ