বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এখন ভাই, তখন স্যার হবেন না তো?

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এ্যানেল : দরজায় কড়া নাড়ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও ঢাকা উত্তর-দক্ষিণের নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে নগরজুড়ে ভাইয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকশ’ গুণ! সামনে ভাই, পেছনে ভাই, ডানে ভাই, বামে ভাই, ভাই আর ভাই! আমার ভাই তোমার ভাই! অমুক ভাই, তমুক ভাই- চেনা-অচেনা নাম না জানা এখন সবাই যেন ভাই আর ভাই। ২৮ এপ্রিল সিসিসি ইলেকশন উপলক্ষে আতিক্ক্যা ভাইয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। আতিক্ক্যা ভাইদের ভিড়ে নগরীতে এখন নড়াছড়া করা দায়। ভোটারদের দেখলেই প্রার্থীরা দৌড়ে গিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরছেন! আহ কি চমৎকার! কে ধনী কে গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। মাইকের আওয়াজে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর চট্টগ্রাম এখন সরগরম আমার ভাই তোমার ভাই স্লোগানে। গত কয়েকদিন থেকেই আননোন নম্বরে একাধিক ফোন পাচ্ছি। ফোন রিসিভ করা মাত্রই অপর প্রান্ত থেকে অচেনা কণ্ঠে কেউ বলে উঠছেন! ভাই কেমন আছেন? আমি আপনার ছোট ভাই এবার অমুক মার্কায় নির্বাচন করছি! আপনি তো আমার ভাই, আমার মার্কাটা একটু দেখবেন, সবাইকে বলবেন। এখন থেকে আমি আপনার ভাই যে কোনো সুখে-দুঃখে আমাকে ডাকবেন আমি পাশে থাকব। ভাই আমার মার্কাটা কিন্তু অমুক মনে রাখবেন ২৮ এপ্রিল। প্রতি উত্তরে বললাম জ্বী, মনে রাখব। ফোন রাখা শেষ হতে না হতে আবারও ফোন। আরে ভাই কেমন আছেন? কী খবর পরিবারের সবাই কেমন আছে? খোঁজ নিতে ফোন করলাম কাল বাসায় গিয়েছিলাম আপনাকে পাইনি। ভাই আমি ভোট করছি। আমার মার্কাটা .. ..! এলাকার ছেলেরা জোর করে আমাকে কাউন্সিলরে দাঁড় করিয়েছে। আপনার সহযোগিতা লাগবে, আপনি তো লেখালেখি করেন, সাংবাদিক মানুষ পত্রিকায় আমাকে একটু তুলে ধরবেন। জানতে চাইলাম কী তুলে ধরব? আমি তো আপনাকে তেমন চিনি না! উত্তরে প্রার্থী নিজের ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরলেন। যার মধ্যে সিকি ভাগ ও জনকল্যাণের মধ্যে পড়ে না। তবু তিনি আজ ভাই! কখনো কারো উপকার করেছেন তার কোনো নজির না থাকলেও নির্বাচনের কারণে পোস্টারে সমাজ দরদী পরোপকারী সৎ ও যোগ্য ভাইয়ের অভাব হচ্ছে না! এখন যারা ভাই পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত হলে তারা স্যার হয়ে যাবেন না তো? ভোট একটি পবিত্র আমানত। ভোট দেয়া নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব এই সেøাগান পরিবর্তন হয়ে আমার ভোট আমি দেব দেখে-শুনে-বুঝে দেব রূপান্তরিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভোট উৎসবে দেশের মানুষের অংশগ্রহণ সঙ্কোচিত হয়ে যাওয়ায় এবারের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হবে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোরও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি পরিবর্তন হবে। ৫ জানুয়ারি ভোটবিহীন নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থান ও টানা ৯২ দিনের অবরোধ এবং সহিংস হরতালের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে এনেছে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দেশের মানুষ আশা করে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনপরবর্তী ও দেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা অপরিবর্তিত থাকবে। তাই যে কোনো উপায়ে নির্বাচন কমিশনকে তিন সিটি করপোরেশন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকীকরণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো জাতীয় রাজনীতির বাইরে রাখা হয়েছে। তারপরও এসব নির্বাচনে রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত এখন রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। তাই বিভিন্ন মহল ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে দলগত নির্বাচনের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠছে। জাতীয় নির্বাচনের বাইরে স্থানীয় নির্বাচনগুলো দলনিরপেক্ষ হওয়ায় বাঞ্ছনীয়। তা না হলে এসব নির্বাচনে সৎ যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের প্রার্থী সমীকরণে বিএনপির জটিলতা থাকলেও চট্টগ্রামে নেই তাই বিএনপি প্রার্থী মনজুর আলমই আর আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী হয়ে চমক দেখিয়েছেন আ জ ম নাছির উদ্দিন! কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে ভোটারদের মাথাব্যথা না থাকলেও কে হচ্ছেন নগর পিতা- এ নিয়ে ভোটারসহ নগরবাসীর জিজ্ঞাসার শেষ নেই? বিরামহীন প্রচারণায় অবিরাম গণসংযোগ পথসভা ও নগরে অবস্থিত বিভিন্ন উপজেলার মানুষের সাথে মতবিনিময় সভা ও গণযোগাযোগে নাছির এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। নাছির উদ্দিনের হাতি আর মনজুর আলমের কমলা নিয়ে গান-কবিতা-রম্যকথা ছড়িয়ে পড়ছে নগরীতে। ভোটের রাজনীতিতে তারুণ্যের বাতিঘরখ্যাত নাছির নতুন হলেও মনজুর প্রবীণ। হেভিওয়েট নবীন-প্রবীণ প্রার্থীর ভোটযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়। একদিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, অন্যদিকে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান নিয়ে ভোটযুদ্ধে এখন দুই প্রার্থীর সাথে বিজয়ের আশায় প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টি সমর্থিত সোলায়মান আলম শেঠও। নগর নির্বাচনে সোলায়মান শেঠ নতুন হলেও প্রচার-প্রচারণায় অনেক প্রসিদ্ধ। বসে নেই ইসলামিক ফ্রন্টের মাওলানা এম এ মতিন ও ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা ওয়াজেদ হোসেন ভূইয়াও। গণসংযোগ পথসেবায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সব প্রার্থীই। অপেক্ষা এখন কেবল ২৮ এপ্রিলের। ভোটারদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মানও নতুন চমক! প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রচার-প্রচারণায় জলাবদ্ধতাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নগর জীবনের নাগরিক দুর্ভোগের মধ্যে জলাবদ্ধতার সমস্যা আসল সমস্যা নয়। পরিকল্পিত নগরায়ন ও বাসযোগ্য শহর বাস্তবায়ন করতে হলে কী কী করবেন, তা কোনো প্রার্থীই সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেননি। দীর্ঘ তিন দশক থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে সিঙ্গাপুর বানানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে, কিন্তু কীভাবে সিঙ্গাপুর হবে তার উদাহরণ নেই। পানির নিচে মুরাদপুর কেমনে হবে সিঙ্গাপুর- এমন স্লোগান নিয়ে নগরবাসী মিছিল মানববন্ধনও করেছে। অন্যদিকে গত এক দশক থেকে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। যে নগরে গাড়ি চলে হাতের ইশারায়, সে নগর কী করে সিঙ্গাপুর কিংবা আধুনিক বিশ্বের সেরা নগরী হবেÑ তা প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে? সরু গলি আর ইট-পাথরের শহরে একের পর এক অপরিকল্পিত নির্মাণযজ্ঞের কারণে নগর জীবনে নাগরিক দুর্ভোগ, জলজট, যানজট, রিকশাজট তার ওপর আবার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও টমটমের অত্যাচার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যত্রযত্র হাট-বাজার ও ধুলা-বালির কারণে নগরে নাগরিক জীবনে স্বস্তি নেই। তাই নগরবাসীর সুখ-স্বস্তির জন্য প্রকৃত অভিভাবক নির্বাচিত করতে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একজন সৎ, ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ ও পরোপকারী নগরসেবক আমাদের সবার কাম্য। যিনি সত্যিকারের নগরবাসীর ভাই হবেন, স্যার নন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্যারের ভূমিকায় নয়, ভাইয়ের ভূমিকায় কাজ করবেন- এটাই প্রত্যাশা নগরবাসীর।
লেখক : সংগঠক ও কলামিস্ট
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ