DailySangram-Logo

পাঠকের অভিমত

মত অভিমত

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ প্রস্তাব ও আবেদন

কয়েক হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফ (আ:) এর সাথে সংঘটিত ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। তিনি ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর প্রিয় পুত্র। তার বৈমাত্রীয় ভাইয়েরা তার প্রতি হিংসাবশত ষড়যন্ত্র করে একদিন তাকে একটি পরিত্যক্ত কূপে নিক্ষেপ করে।

Printed Edition

॥ ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল আবেদীন ॥

কয়েক হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফ (আ:) এর সাথে সংঘটিত ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। তিনি ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর প্রিয় পুত্র। তার বৈমাত্রীয় ভাইয়েরা তার প্রতি হিংসাবশত ষড়যন্ত্র করে একদিন তাকে একটি পরিত্যক্ত কূপে নিক্ষেপ করে। মহান আল্লাহর কুদরতে তিনি সেখানেও জীবিত থাকেন। ঘটনাক্রমে একদিন মিশরগামী এক বাণিজ্যিক কাফেলা পানির সন্ধানে সে কূপে তাদের বালতি নামালে আল্লাহর ইশারায় ঐ বালতিতে বসে তিনি উপরে উঠে আসেন। তিনি ছিলেন খুবই সুদর্শন তরুণ। তাকে নিয়ে মিশরের বাজারে বিক্রয় করে প্রচুর অর্থ লাভ করা সম্ভব হবে বুঝতে পেরে কাফেলার সর্দার তাকে মিশর নিয়ে আসে। সেখানের রাজ দরবারের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘আজিজ মিশির’ নিজ স্ত্রীকে উপহার প্রদানের মানসে ইউসুফকে ক্রয় করে নিয়ে আসেন। ইউসুফের (আ:) বুদ্ধিমত্তা, কর্র্মতৎপরতা ও মধুর আচরণে আজিজ মিশির অতীব প্রীত হন এবং তার হাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। অনেক নাটকীয়তার পর তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

কারাগারের প্রহরীরা এবং অন্যান্য বন্দীগণ ইউসুফের সত্যবাদিতা, আচার- আচরণ, কর্তব্যনিষ্ঠা, সুমিষ্ট ব্যবহার, একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত ইত্যাদি গুণাবলি পর্যবেক্ষণ করে অনুধাবন করে যে, তিনি অপরাধী নন বরং জুলুমের শিকার। তারা তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ইউসুফের কাছে আসত, তিনি ধৈর্য্যরে সাথে শ্রবণ করে সুন্দর সমাধান বলে দিতেন। এভাবে তিনি ছিলেন কারাগারে সকলের শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। একবার দুজন বন্দী তাদের নিজ নিজ স্বপ্নে দেখা ঘটনার ব্যাখ্যা জানার জন্য তার নিকট আগমণ করে। প্রথম জন জানায় যে, সে দেখেছে সে রাজাকে পানীয় পান করাচ্ছে। দ্বিতীয় জন জানায় যে, সে দেখেছে তাকে ঊঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং পাখী তার মাথায় বসে রুটি ও তার মগজ ঠুকরে খাচ্ছে। স্বপ্নের ব্যাখ্যায় ইউসুফ (আ:) প্রথম জনকে জানালেন যে, সে অচিরেই মুক্তি পাবে এবং রাজ দরবারে পানীয় পান করানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হবে । দ্বিতীয় জনকে জনালেন যে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে এবং আমৃত্যু তাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হবে। অল্প দিনের ব্যবধানে উভয় ব্যাখ্যাই বাস্তবে রূপায়িত হলো।

কিছুদিন পরে রাজা একটি স্বপ্ন দর্শন করে অস্থির হয়ে উঠেন। তিনি দেখেন যে, সাতটি শীর্ণকায় গরু সাতটি মোটা তাজা গরুকে ভক্ষণ করে ফেলছে। এর ব্যাখ্যা জানার জন্য তিনি রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন বিশারদ এবং ধর্মীয় গুরুদের রাজ দরবারে তলব করেন। অনেক চেষ্টা-গবেষণা করেও তারা এ স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হলো না। এ সময় দরবারে পানীয় পরিবেশনকারী রাজাকে ইউসুফ (আ:) সম্পর্কে অবগত করেন। তিনি রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করেন যেÑ প্রথম সাতটি বছর মিশরে খুবই ভাল শস্য উৎপাদিত হবে, কিন্তু পরবর্তী সাত বছর হবে অনাবৃষ্টি ও অনাবাদি। ফলতঃ সেই সাত বছরে হবে দুর্ভিক্ষ। রাজা করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চাইলে ইউসুফ (আ:) পরামর্শ রাখেন যে, প্রথম সাত বছরে উৎপাদিত শস্যের অতিরিক্ত অংশ মজুত করে রেখে তাদ্বারা পরবর্তী অনাবাদি সাত বছরে খাদ্য সরবরাহ জারী রেখে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে হবে। রাজা এর দায়িত্ব সানন্দে তার উপরই অর্পণ করেন। তিনি বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত শস্য মজুত ও পরবর্তীতে অতীব দায়িত্বশীলতা, বিশ্বস্ততা ও সফলতার সাথে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করেন।

এবার সাম্প্রতিককালের একটি উদ্যোগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল হতে গৃহীত ঋণ একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তারা মরিয়া হয়ে তা হতে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে। এ লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের প্রথমদিকে তারা শুরু করে স্বর্ণ সংগ্রহ অভিযান। কিম ডাই জং সরকার জনগণকে এ স্বর্ণ সংগ্রহ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। সারা দেশব্যাপী প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন লোক এ অভিযানে অংশ নিয়ে সংগ্রহ করে প্রায় ২২৭ টন সোনা যার মূল্য প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই তারা ২০০১ সালের আগষ্ট মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল হতে গৃহীত ঋণের ১৯.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে সমর্থ হয়। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক ও সামাজিক সংগঠন এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। দেশপ্রেম ছিল মূল চেতনা। (Economic history of south korea)

এবার দেখা যাক আমাদের জনগণ ও দেশের জন্য আমরা কী করতে পারি! আপনাদের সকলের প্রতি দেশের স্বার্থে আমি একটি আবেদন রাখতে চাই। আমরা সবাই এখন জানি যে, বিগত সরকার দেশ হতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দেয়ায় একদিকে দেশ অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকছে আপরদিকে জনগণের প্রত্যেকের ঘাড়ে চেপে আছে বিদেশী ঋণের বিরাট বোঝা। এ অবস্থা হতে মুক্তির লক্ষ্যে সকলের প্রতি আমি একটি আবেদন রাখতে চাইÑ আসুন!! আমরা প্রত্যেকে প্রতিমাসে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী নিজ নিজ আয় হতে ক্ষুদ্র একটি অংশ আমার জন্য তৈরি নির্দিষ্ট একটি একাউন্টে নিয়মিতভাবে জমা করব। হোক তা যতই ক্ষুদ্র। যেমন একজন রিক্সা পুলার বা দিন মজুরের ক্ষেত্রে তা হতে পারে দশ টাকা, অন্যদিকে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ক্ষেত্রে তা হতে পারে এক হাজার টাকা। অংকটি কেউ নির্ধারণ করে দেবেনা, প্রত্যেকে নিজেই নির্ধারণ করবেন। তবে নিয়মিতভাবে জমা করতে হবে। প্রবাসীরা যে যেখানে থাকেন তিনি সেখানকার মুদ্রা যেমন- € $ রিয়াল, দিনার ইত্যাদি জমা করবেন। এভাবে জমা করলে ৬ মাস পরে দেখা যাবে যে ঐ সকল একাউন্টে বেশ বড় একটি অঙ্ক জমা হয়েছে।

এ জমাকরণ ও অর্থ সংগ্রহ কাজটি কিভাবে পরিচালিত হবে? এ কাজে আমি সকল সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন এমনকি রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আবেদন রাখতে চাই যে- আপনারা সাংগঠনিক জনশক্তিকে এ বিষয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত করুন, সরকারের প্রতি পরামর্শÑ আপনারা ১০/১৫টি ব্যাংক নির্দিষ্ট করুন। ব্যাংকগুলো প্রত্যেকে তাদের কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে পাঠিয়ে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য এ মর্মে একটি একাউন্ট খুলে দেবে। অতঃপর জনগণ প্রত্যেকে নিজ নিজ একাউন্টে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে প্রতি মাসে তার নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা করবেন।

তবে এটা আশা করা যায় না যে, এ টাকা জমা করার জন্য কেউ তার ব্যাংক এ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন। তাই সরকারকে একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার কিকাশ/ নগদ এর সাথে এ মর্মে এবটি চুক্তিতে আসতে পারে যে এ টাকা জমাকরণের নিমিত্তে তাদের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ মুক্তভাবে এ কাজে নির্দিষ্টকৃত একাউন্টে টাকা জমা করা যাবে। এ জমাকরণ দু শর্তে হতে পারে-প্রথমত দেশকে ঋণমুক্ত করার লক্ষ্যে, দেশের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে, যা হবে অফেরতযোগ্য। দ্বিতীয়ত-ঋণের বোঝা মুক্ত হবার পরে সরকার প্রত্যেককে তার জমাকৃত অর্থ ক্রমান্বয়ে ফেরত দিয়ে দেবেন।

এখন দেখা যাক, সরকার ঐ টাকা কী কাজে ব্যবহার করবেন। বিভিন্ন নিত্যপণ্য যেমন চাল, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদি আমদানিকরণে বা ভর্তুকি প্রদানে ব্যয় করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সহজতা আনতে পারেন, অথবা কোন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেন যাতে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে, অথবা আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় করে আমাদের ঘাড়কে ধীরে ধীরে হালকা করতে পারেন।

ধারণাটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত। অনেকের মনোপুত নাও হতে পারে। তবে যাদের পছন্দ হয় তাদের প্রতি আবেদন- আসুন! আমরা শুরু করি। অবশ্য সরকারকে জমাকরণের ব্যবস্থাপনা করে দিতে হবে। সরকারের প্রতি আবেদন- উদ্যোগ গ্রহণ করুন। দেশকে এগিয়ে নিতে আমরা আগ্রহী। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমীন!

লেখক : শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানমন্ডি।