DailySangram-Logo-en-H90

পাঠকের অভিমত

অজুহাত নয়; কাজ করা প্রয়োজন

যাদের ভালো কাজ করার যোগ্যতা ও প্রতিভা নেই, তাদের কাজ না করা বা খারাপ কাজ করার প্রধান অনুসঙ্গই অজুহাত। যারা কাজ করতে চান বা কাজ করার মত যোগ্যতা রাখেন তাদের ইচ্ছাশক্তি বা যোগ্যতাই তাদেরকে কাজ করতে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। অজুহাত তাদের কোন ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না বরং প্রতিভাই তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাগিদ প্রদান করে কাজ করার।

Printed Edition

॥ হাসনা হেনা ॥

যাদের ভালো কাজ করার যোগ্যতা ও প্রতিভা নেই, তাদের কাজ না করা বা খারাপ কাজ করার প্রধান অনুসঙ্গই অজুহাত। যারা কাজ করতে চান বা কাজ করার মত যোগ্যতা রাখেন তাদের ইচ্ছাশক্তি বা যোগ্যতাই তাদেরকে কাজ করতে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। অজুহাত তাদের কোন ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না বরং প্রতিভাই তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাগিদ প্রদান করে কাজ করার। মূলত, আমরা নিজেরাই জীবন ও কর্মের সাথে অজুহাতকে একসাথে গেঁথে নিয়েছি। বস্তুত, আমাদের জীবনে তিনটি হাতের মধ্যে দু’টি দৃশ্যমান; আর অপরটি অদৃশ্যমান। সেটি হচ্ছে অজুহাত। এ অজুহাত আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু এটা জীবনকে ধংস করে দেয়। কর্মক্ষমতা ও অভিপ্রায়কে বিপথগামী করে।

এখন আসি অজুহাত কাকে বলে? মূলত, অজুহাত হচ্ছে এক ধরনের আত্মপ্রতারণা। আক্ষরিক বা শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ওজর, কারণ, উসিলা, হেতু, ছুতা ও বাহানা। আমাদের জীবনের প্রতিটা ধাপ ও প্রতিটা চিন্তার পিছনেই অজুহাত জড়িত বা সক্রিয় রয়েছে। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে অত্যাচারী, স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য না অজুহাতই কাজে লাগিয়েছেন। মানুষকে গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সংঘটিত হয়েছে এমনসব অজুহাতকে কেন্দ্র করেই। হয়ে উঠেছেন অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসক। এদের মধ্যে চেংগিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, অগাস্টাস, নাদির শাহ, জোসেফ স্টালিন অন্যতম বলা চলে। অনেকে দিগি¦জয়ী হওয়ার অজুহাত, জনপ্রিয়তার অজুহাত কাজে লাগিয়ে ক্ষতি করেছেন মানুষের, ধ্বংস করেছেন শত শত জনপদ, হত্যা করেছেন লক্ষ-কোটি বনি আদম। কাজেই বুঝা যায় অজুহাত মানেই নেগেটিভ শক্তি, যে শক্তিকে মানুষ কাজে লাগায় নেগেটিভ প্রবৃত্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। যা মানুষের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়; বরং নেতিবাচক বৃত্তেই এর অবস্থান।

এ বিষয়ে পুরনো ও অতিপ্রচলিত একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও হৃদয়গ্রাহী ও সহজবোধ্য করা যেতে পারে। গল্পটি হলো, এক বাঘ খাবারের সন্ধানে জঙ্গলে ঘোরাফেরা করতে থাকে। হঠাৎ দেখে একটা হরিণের বাচ্চা জলাশয় থেকে পানি খাচ্ছে। হরিণ শাবক দেখে বাঘের লোভ হলো খাওয়ার জন্য এবং হরিণ শাবকের কাছে যেয়ে বললো, ‘আমি তোকে এখন খাব’।

শাবকটি বললো, কেন?

বাঘ জবাবে বললো, তুই আমাকে ভেংগাইছিস।

হরিণ শাবক জানতে চাইলো-কবে?

বাঘ জবাবে বললো-গত বছর।

হরিণ শাবক উত্তরে বললো-গত বছর ত আমি জন্মা-ই নি।

-তাইলে তোর বাপ ভেঙাইছে, এ কথা বলে শাবকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

মূলত, ভালো কাজের জন্য ব্যক্তি সদিচ্ছার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মন্দ কাজের প্রধান অনুসঙ্গই হচ্ছে অজুহাত। আর এ অজুহাতই মানুষকে মনুষত্ব থেকে পশুত্বে নামিয়ে দেয়।

মানুষ কোন কাজ না করার ক্ষেত্রে অজুহাতকে কাজে লাগায়। মূলত, ফাঁকি দেওয়ার অশুভ প্রবণতা থেকেই অজুহাত নামক অপসংস্কৃতির সৃষ্টি। ‘কাজ সময়মত না করার চেয়ে পরে করার অজুহাত আরও বেশি ভয়ংকর’-পার্কিনসন। বস্তুত, অজুহাত দুর্ভাগ্যের অন্যতম হাতিয়ার। সঙ্গত কারণেই ‘কারণ’ ও অজুহাতের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। কারণ (ৎবধংড়হ), কারণ সবসময় যুক্তিসংগত এবং গ্রহণযোগ্য। অপরপক্ষে অজুহাত (বীপঁংব) দায়িত্ব এড়ানো ও অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো।

সফল মানুষেরা কখনো অজুহাতকে প্রশ্রয় দেয় না। অনেক সক্ষম লোকও ভিক্ষা করে। অথচ অনেক হাত-পা হীন মানুষও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। উদাহরণস্বরূপ হাত-পা ছাড়াই বিশ্ব জয় করার এক অদম্য যোদ্ধার নাম অস্ট্রেলিয়ার নিক ভুজিসিক। জন্ম থেকেই হাত-পা নেই। অথচ বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যক্তি তিনি। তিনি একজন ঊাধহমবষরংঃ (ধর্ম প্রচারক), গড়ঃরাধঃরড়হধষ ংঢ়বধশবৎ (প্রেরণাদায়ক বক্তা)।

দুর্বল চিত্তের মানুষের মধ্যে এ অজুহাত বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে বিভিন্ন চিন্তা চেতনার মাধ্যমে অজুহাত প্রবণতা দূর করতে হবে। অন্যেরা কী ভাবছে তা এড়িয়ে চলতে হবে। জীবন বিপন্ন হবে এ ভয়ে অনেকে অনেক কাজে নামে না। এজন্য মানুষ একবারই বাঁচে- এমন চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

মানুষ সাধারণত নিজেদের আড়াল করার জন্য পরিবেশ, পরিস্থিতি, যুগকে গালাগালি করে। অনেক মানুষ পান থেকে চুন খসতেই নিজের ভাগ্যকে গালি দেয়। এটা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্র্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেন-আদম সন্তান সময় ও কালকে গালি গালাজ করে, অথচ আমিই সময় আমার হাতেই রাত্রি ও দিবস। -মুসলিম, হাদিস (৫,৭৫৫)। মানুষের চারিত্রিক স্খলন যা অশান্তির মূল কারণ, সময় এবং পরিবেশকে প্রভাবিত করে। আর আমরা এটাকেই অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করি। তবে যতদিন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি আসবে না ততদিন পর্যন্ত সমাজে শান্তিও আসবে না।

কাজেই এ অজুহাত থেকে মানুষকে বের হয়ে আসতেই হবে। এটার সাথে মানুষের মনোজগতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ জাতীয় মানুষ আপাতত অজুহাত দাঁড় করিয়ে ক্ষণিকের মুক্তি পেলেও তারা সবসময় একরকম মর্ম পীড়নে ভোগে। এ মন্দ অভ্যাসের কারণে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত অজুহাত প্রবণতা মানুষকে মিথ্যাবাদী বানায়। আর মিথ্যা হচ্ছে সব পাপের জননী। অজুহাত কোন সমাধান নয়- ভাবতে হবে। আল্লাহকে ভয় করতে হবে, সত্যকে ধারণ ও লালন করতে হবে। অজুহাত হচ্ছে এক ধরনের চালাকি। এজন্য স্টিভ জবসের উক্তিটি সত্যিই প্রাণবন্ত ও যথার্থ “ঝঃধু যঁহমৎু, ংঃধু ভড়ড়ষরংয” আমাদের কাজে ফিরে আসতে হবে, অজুহাত এড়াতে হবে। তাহলেই সাফল্য আমাদের হাতে ধরা দেবে।

লেখিকা : অধ্যাপিকা, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, ঢাকা।