DailySangram-Logo-en-H90

পাঠকের অভিমত

মৎস্যকে খাদ্যরূপে গ্রহণে সাবধানতা

পরিবর্তনের কারণের দিকে আমরা খেয়াল করি না, অনেক সময় পরিবর্তনের কারণগুলি আজানাই রয়ে যায়। প্রকৃতির এসব পরিবর্তন, বিবর্তন, ধ্বংস ও সৃষ্টির মূলে লুকিয়ে রয়েছে যেসব বৈজ্ঞানিক কারণ তা জেনে নিতে পারলে অনেক অনাসৃষ্টি থেকে সৃষ্টিজগত রক্ষা পেতে পারে।

Printed Edition

॥ মনসুর আহমদ ॥

নিকট অতীতেই দাবি করতাম আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। আমাদের পুকুর, ডোবা নালা ভরা মাছ ছিল, গোলাভরা ধান ছিল। আজ সেই পুকুর গোলা সব মাছ ধান শূন্য। পরিবর্তনের কারণের দিকে আমরা খেয়াল করি না, অনেক সময় পরিবর্তনের কারণগুলি আজানাই রয়ে যায়। প্রকৃতির এসব পরিবর্তন, বিবর্তন, ধ্বংস ও সৃষ্টির মূলে লুকিয়ে রয়েছে যেসব বৈজ্ঞানিক কারণ তা জেনে নিতে পারলে অনেক অনাসৃষ্টি থেকে সৃষ্টিজগত রক্ষা পেতে পারে।

প্রকৃতি জগতের অনেক বিপর্যয়ের মতো মাছের ধ্বংস ও তাদের প্রজাতির অবলুপ্তির জন্য মানুষ দায়ী। এ দায়ী হওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পেছনে রয়েছে প্রকৃতি জগতে মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ফলে অধিক ফসল ফলানোর জন্য ফসলের জমিতে ছড়ান হচ্ছে রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদন, কীট নাশক ওষুধ। এগুলো নদীনালা, খালেবিলে ছড়িয়ে থাকা মাছের ডিম নষ্ট করে চলেছে। যে কারণে মাছের সংখ্যা কমার সাথে সাথে মাছের বিভিন্ন প্রজাতির অবলুপ্তি ঘটছে।

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শুধু মাছেরই ক্ষতি সাধিত হচ্ছে না মাছের মাধ্যমে মানুষের দেহেরও বিভিন্ন ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। আমরা মাছকে খাদ্যরূপে গ্রহণ করে আমিষের প্রয়োজন মিটাই। এ আমিষের প্রয়োজন মেটাতে আমরা মাছের মাধ্যমে আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন বিষ গ্রহণ করে থাকি যার খবর আমরা রাখি না। মাছ খাদ্যরূপে গ্রহণ করার চেয়ে গ্রহণ না করা যে অনেক সময় উত্তম তা আমরা মোটেই খেয়াল করি না। কোন বিল নদী জলাশয়ের মাছ ধরে অমরা খাই তা আমাদের জানা যেমন প্রয়োজন; তেমনিভাবে প্রয়োজন খাদ্য হিসেবে মাছ কীভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে হবে সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।

স্থলজ উৎস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন বস্তুতে মিথাইল মার্কারির পরিমাণ নগণ্য বলেই বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক উৎসের দিকে নজর দিয়েছে। মানুষের শরীরে এই মার্কারি গহ্রণের একটি সহ্য সীমা আছে । সাপ্তাহিক সমুদ্র সীমার বাইরের মাত্রার মিথাইল মার্কারি বার বার শরীরে প্রবেশ করলে খুবই মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সাপ্তাহিক সহ্যসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একজন ৭০ কেজি ওজন বিশিষ্ট লোকের জন্য সাপ্তাহিক সহ্যসীমা মিথাইল মার্কারীর জন্য ০.২ মিলিগ্রাম এবং পারদের জন্য ০.৩ মিলিগ্রাম।

এ ছাড়াও বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে নদীতে ফেলা হচ্ছে। যে সবের মধ্যে মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান রয়েছে। এ সব উপাদান নদীর পানিতে মিশে যায়। ফলে এ পানির মাছ খাদ্যরূপে গ্রহণ করলে ঐ সব বিষাক্ত উপাদান মছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সে কারণে মাছ বাজারজাতকরণে সাবধানতা ও নিয়মনীতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। ভোক্তাদের উচিত মাছ ক্রয়ের সময় কোন নদী বা বিলের মাছ তা জেনে নেওয়া। এ বিপদ থেকে রক্ষার জন্য নাগরিক সচেতনতার সাথে সাথে শিল্পকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজন কঠোর নীতিমালার প্রয়োগ ও অনুসরণ। সাধারণ নাগকিদের এ ব্যাপারে জানা বেশ কঠিন। তাই সরকারের পরিবেশ দূষণ ও মৎস্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে মানুষকে সাবধান করা জরুরি।

দূষিত মাছ খেলে অনেক বিপদ হতে পারে। ১৯৫৬-’৭১ সালের মধ্যে জাপানে মিনাসাটা উপসাগরের মাছ খেয়ে ৬৫৮ জন লোক আক্রান্ত হয় এবং এদের মধ্যে ৭৮জন মৃত্যুবরণ করে। কারণ এ উপসাগরের মাছ মিথাইল মার্কারি মিশ্রত পানিতে বাস করতো। জাপানে নিগারের শিল্প অঞ্চলের মাছে পারদ দূষণের ঘটনা ধরা পড়ে। ফলে জাপান সরকার ১৯৪টি শিল্পকারখানায় দূষণ নিরোধ প্রক্রিয়া যাচাই করে এবং কৃষি কাজ জৈব যৌগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। জাপানকে অনুসরণ করে মাছের প্রজাতি রক্ষা, মানুষের সুস্বাস্থের জন্য আমাদের দেশের সরকারের উচিত কৃষিকাজে জৈব যৌগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এবং মাছ বাজারজাত করণের সুষ্ঠু বিধানমালা প্রণয়ন করা।

মাছ ও মাছজাত দ্রব সংরক্ষণে সাবধানতা অবলম্বন না করলে তা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। মাছ অতি সহজেই (অঁঃড়ষুংরং)অটোলাইসিস অক্সিডেশন এবং হাইড্রোলাইসিস(ঐুফৎড়ষুংরং) এবং পরমাণু জীবদ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তাই অতিদ্রুত মাছ সংরক্ষণ করতে হয়। লবণজাতকরণ, আধা শুকনা বা শুঁটকিকরণ এবং মসলা মাখান পদ্ধতি মাছ সংরক্ষণের জন্য বড়ই কার্যকর। লবণ মিশ্রিত মাছ অতি সহজেই লবণ সহিষ্ণু বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হতে পারে। ফলে মাছ দ্রুত বিবর্ণ হয়ে যায়। ধোঁয়ায় শুকানো মাছের প্রধান ক্ষতিকারক উপাদান ছত্রাক বা ছাতা (গড়ঁষফং), টক সিরায় ডুবানো মাছ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা খুব কম। তবে যদি ঐ সিরায় এসিডের পরিমাণ খুব কম থাকে তা হলে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়ে মাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হিমায়িত মাছ ব্যকটেরিয়া আক্রান্ত হয়ে দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

সাম্প্রতিককালে সমাজের আধুনিকায়নের ফলে মানুষের রেডি ফুড গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। রেডি ফুডে মাছজাত খাদ্য বেশ স্থান করে নিয়েছে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছ ফিস কেক ফিস স্টিক, ফিস কাবাব, ফিস রোল ইত্যাদি। এ সমস্ত খাবার তৈরী করতে মাছকে প্রক্রিয়াজাত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়। যেমন- মাছকে কাঁটা বিমুক্ত করা, আঁশ বিযুক্ত করে পরিষ্কার করা, ভাজা এবং পারিপার্শিক তাপমাত্রায় প্যাকিং করা। ফিস কেক তৈরী করতে আলু, মসলা ও সুগন্ধি মাছের সাথে মিশাতে হয় ; অতঃপর তা চটকিয়ে বিভিন্ন আকার করে তাতে মাখন মাখাতে হয় এবং দ্রুত হিমায়িত করতে হয়।

মাছজাত বিভিন্ন খাবারসহ গোশত ও শাক-সব্জিজাত খাদ্যের ব্যাপারে একটি তদন্তে দেখ যায় যে, সাধারণ দোকান থেকে অনেক বিলাসবহুল দোকানে পর্যন্ত ঐ সব খাদ্য ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত অবস্থায় পাওয় যায়। এ ছাড়া তেজষ্ক্রিয়তা নিবারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করত সক্ষম হলে এ সব খাদ্য টাটকা থাকার সময়সীমা বৃদ্ধি পাবে। মাছ প্রক্রিয়াজাত ঠিক না হলে তাতে এক্রোমানাস, স্ট্যাকিলোকোকাস ইত্যাদি দ্বারা দূষিত হতে পারে। অতএব, মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের জন্য মাছের জন্ম-বৃদ্ধির পরিবেশসহ তা বাজারজাতকরণ, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছজাত দ্রব্য খাদ্য প্রস্তুত করণের প্রতিটি স্তরে অতি সাবধানতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পন্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় এ খাদ্য মানুষের কল্যণের চেয়ে অকল্যাণ বেশি বয়ে আনবে।