DailySangram-Logo

সম্পাদকীয়

মত অভিমত

সড়কে মৃত্যুর শেষ কোথায়

জন্মিলে মরিতে হয়। কিন্তু সবার ভাগ্যে দিন, তারিখ, সময় ঠিক করে মৃত্যু দূত আসে না; বরং আরশের মালিকের নির্ধারিত সময়েই এসে হাজির হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে মেনে নেয়া মেলাভার সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা,

Printed Edition

অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন

জন্মিলে মরিতে হয়। কিন্তু সবার ভাগ্যে দিন, তারিখ, সময় ঠিক করে মৃত্যু দূত আসে না; বরং আরশের মালিকের নির্ধারিত সময়েই এসে হাজির হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে মেনে নেয়া মেলাভার সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা, রেল দুর্ঘটনা কিংবা নৌদুর্ঘটনা মৃত্যু কত যে বেদনার তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবার ব্যতিত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। কারণ যার যায় সে বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা! একটি জীবন কেবল একজন মানুষের একক জীবন নয়! এর সঙ্গে আরো কিছু মানুষের জীবন জড়িয়ে থাকে। ফলে একটি জীবন যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন অন্য জীবনেও বিষণ্ন দুঃষহ যন্ত্রণা হানা দেয়। শান্তির সময়ে সন্তান বাবাকে কবরে শুইয়ে দেয় আর যুদ্ধের সময়ে বাবারা কলিজার টুকরা সন্তানকে কবর দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে তো যুদ্ধ নেই? তাহলে কেন যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি মানুষ সড়কে সড়কে প্রাণ দিচ্ছে? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালেই এধরনের মৃত্যুর খবর চোখে পড়ে। যখন লিখছি তখন পত্রিকার পাতার শিরোনাম ৫ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১১ জন। তবে মনুষ্য সৃষ্টি দুর্ঘটনা মৃত্যু কিছুটা হলেও রোধ করা যায়। যার প্রমাণ নরওয়ে ও সুইডেন। নরওয়ে সড়কে মৃত্যুর হার প্রতি ১০ লাখে ২০ জন, সুইডেনে প্রতি ১০ লাখে ২৫ জন, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডে এই হার ২৭ জন। ওই সব দেশ সড়ক দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?

আমাদের দেশে যতগুলো সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সড়ক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক দুর্নীতি, অনিয়ম আর চাঁদাবাজি দূর হয়নি। ফলে সরকার বদল হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো নয়। অন্যান্য দেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্জন করা যত না কঠিন, তার চেয়ে বেশি কঠিন লাইসেন্স রক্ষা করা। অথচ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন ‘‘গরু-ছাগল’’ চিনতে পারলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশ্বের বহু দেশ নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে সুইডেন সরকার ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে ‘‘ভিশন জিরো’’ (ট্রাফিক নিরাপত্তা প্রকল্প) দেশটির পার্লামেন্টে ভিশন জিরো বিল পাশ করেছিল। সুইডেন সরকার দেশের মানুষকে সড়কে জীবনের নিরাপত্তা দিতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এর সুফল দেশটির জনগণ পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ রকমের কোন উদ্যেগ কোন কালেই স্থাপিত হয়নি। যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন ফলাও করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। ওই পর্যন্তই শেষ! কিছু দিন গেলে আবার একই রীতি ফিরে আসে। পাঠকদের নিশ্চয় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দু শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা মনে থাকার কথা। ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে যাত্রীবাহী বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় এসব শিক্ষার্থীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

নিহত কলেজ শিক্ষার্থীদের সহপাঠীরা হত্যার প্রতিবাদে সেদিন বিক্ষোভ করেছিল। সে বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আর সে ঝড়কে হাসি দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সাইক্লোনে পরিণত করেছিল। তাঁর অট্ট হাসি সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। সে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর সরকার নিাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করেছিল। ফলশ্রুতিতে এখন ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়।

প্রতিটি মৃত্যু কাউকে না কাউকে কাঁদায়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমাদের দেশে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। যার প্রমাণ তো অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, গত দুইদশকে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৯৮৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিআরটিএর হিসাব অনুসারে প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার ৩৮০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০২১ সালে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮৪ জনের। (সূত্র : বণিক বার্তা ৯ জানুয়ারি ২০২৫) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে প্রায় ৩৩ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫৩ হাজার ১৯৬ জন মানুষ, ৩৫ হাজার ৩৮৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যার ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়ের ৯টি জাতীয় সংবাদপত্র, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং সংস্থার নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংগঠনটি। (সূত্র : প্রথম আলো, ১৬ অক্টোবর ২০২৪)

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন মারফত জানা গেছে, গত বছর ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছেন যা মোট নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত ১০ বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে বেড়ে ৬০ লাখ হয়েছে। নতুন করে ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্তায় নামার পাশাপাশি ছোট যানবাহন অবাধে বেড়েছে। এসব যানবাহনের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ভয়াবহভাবে বাড়ছে। (সূত্র : প্রথম আলো, ০৪ জানুয়ারি, ২০২৫) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে দেশে ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে। (সূত্র: বণিক বার্তা, ৯ জানুয়ারি ২০২৫)

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাপান একটা সমাধান বের করছে। তারা রাস্তার মধ্যে বাচ্চাদের থ্রিডি ছবি এঁকেছে, যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন বাচ্চা রাস্তার মধ্যে চলে এসেছে। এটা দেখার পর ড্রাইভার আগ থেকে সতর্ক হয়ে যায়। ফলে সেখানে দুর্ঘটনার হার অনেকটাই কম। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজন- দক্ষ চালক তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ড্রাইভারদের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাড়ির লাইসেন্স দেয়া ও নবায়ন করার ব্যবস্থা করা, প্রতিবছর কমপক্ষে একবার চালকদের ড্রাইভিং পরীক্ষা গ্রহণ করা,চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা সুনির্দিষ্ট করা, পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার অভ্যস্ত করা, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধ করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, ছোট ছোট গাড়ি চলার জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি করা, সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, প্রত্যেকটি গাড়ীর ড্রাইভারদেরকে ডোপ ট্রেস্টের আওতায় আনা, রাস্তাঘাটের উপর বাজার বন্ধ করা, ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা।

বিশেষ করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সারা পৃথিবীতে যে ২০টি কারণে মানুষ মরছে এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার স্থান দ্বিতীয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এক সময়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষ মৃত্যুর প্রধান কারণ হবে সড়ক দুর্ঘটনা। সুতরাং একটি ‘‘দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’’ এই সাবধানী বাণী সবারই মনে রাখা প্রয়োজন। লেখক : কলামিস্ট