সম্পাদকীয়
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের অধিকার
Printed Edition
তিস্তা নদীর হিস্যা প্রাপ্তি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে বহুদিন ধরে আলাপ আলোচনা চললেও কার্যত এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ভারত এ সংকটের সুরাহা করতে মোটেও আন্তরিক নয়; এমনটাই বিগত বছরগুলোতে প্রতীয়মান হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৯০ সালে তিস্তা বাঁধ নির্মিত হলেও পরিকল্পিত সাত লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে প্রথম পর্বে সেচকাজ চালু করার জন্য ১৯৯৩ সালে প্রয়োজনীয় খাল খনন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত বিনির্মাণের কাজ শেষ করে আনা হয়। সে সময় সীমিত সুযোগসুবিধা নিয়ে প্রকল্প এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কিছু সেচ কার্যক্রম চালু করা হলেও ১৯৯৮ সালে পরিকল্পিত দুটি প্রকল্পের প্রথম পর্বটির কাজ শেষ হয়। কিন্তু সংকট দেখা দেয় প্রকল্প চালু রাখতে প্রয়োজনীয় পানির। তিস্তার উজানে গজলডোবায় ভারত আগেই একটি বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে নির্মিত তিস্তা বাঁধ সেচ প্রকল্পে পানির বিশেষ সংকট দেখা দেয়। কিন্তু ১৯৯৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত, অর্থাৎ গত ২৭ বছরেও ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়নি। ফলে বর্তমানে তিস্তা বাঁধ সেচ প্রকল্প প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। হিমালয়ের পাদদেশে সিকিম রাজ্যে তিস্তার জন্ম হলেও বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় ১২৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
তিনটি ফসল মৌসুমে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্বে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু পানির অভাবে খরাপীড়িত উত্তর-পশ্চিম বাংলার এ অঞ্চলটি বিরানভূমি হিসেবে পড়ে থাকে। শীত মৌসুমে সাধারণত তেমন কোনো ফসলই ফলে না। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি-মার্চ এ সময়টায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে কোনো প্রবাহই থাকে না, থাকে শুধু একটি অত্যন্ত ক্ষীণধারা, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আবহাওয়াবিদদের মতে, উত্তরে হিমালয় না থাকলে এবং বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত না হলে এ অঞ্চলটি বহু আগেই মরুভূমিতে পরিণত হতো। তিস্তা ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রাণধারা হলেও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তিস্তাভিত্তিক সেচের পানির ওপর। কিন্তু সেখানে তিস্তার প্রবাহ বৃদ্ধি, নদী খনন কিংবা তার পাড় ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ দেখা যায় না। বাংলাদেশের খরাপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূখ- তিস্তার উপকূলে অবস্থিত হলেও এ অঞ্চলের পাওনা ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বছরের পর বছর। আন্তর্জাতিক কিংবা অভিন্ন নদী ও সীমান্ত জলাধারের পানিসম্পদ ব্যবহারের কোনো প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন কিংবা নিয়মের তোয়াক্কা করছে না ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। শুধু রাজনৈতিক বুলি কিংবা অনিশ্চিত আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিবঞ্চিত ও অভাবপীড়িত মানুষকে আর বেশিদিন ভুলিয়ে রাখা সম্ভবও হবে না। কেন না তাদেরও ধৈর্যের বাঁধ এখন ভেঙে গেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ও মর্মান্তিক বিষয় হলো, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকলো। তাদের সাথে ভারতের সম্পর্কের গভীরতাও সর্বজনবিদিত। অথচ আওয়ামী লীগও ভারতের কাছ থেকে তিস্তা নদীর পানির হিস্যা আদায়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বহুবার শেখ হাসিনা ভারতে গিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও দেশে এসেছেন। এর বাইরে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বিপাক্ষিক সফরও হয়েছে অসংখ্যবার। এসব সফরে আরো অনেক বিষয়ে চুক্তি হলেও, এমনকি স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও তিস্তা নদীর পানির বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের সরকারের ওপর দায় চাপিয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। মাঝখান দিয়ে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ২৭ বছর অনেক লম্বা সময়। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই বঞ্চিত হয়েছে কিন্তু আর নয়। আমরা আর কোনো ছলচাতুরি বা আশ^াসের প্রলোভনে পড়তে চাই না। বরং অনতিবিলম্বে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান কাম্য।