জাতীয় বাংলাদেশ
ফ্যাসিবাদী দলের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন
নেই অনুশোচনা ষড়যন্ত্র তত্ত্বেই ভরসা আ’লীগের
বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে কিংবা প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী দোসরদের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন।
জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমলা নির্ভর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থেকে গুম, খুন, দুর্নীতি, জুলুম নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করে। অবশেষে ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। পার্শ্বের দেশ ভারতে অবস্থান করে এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন নানা রকমের যড়যন্ত্র। বিগত দিনে অপকর্মের জন্য কোন ধরনের অনুশোচনা নেই দলটির বরং নানা রকমের ষড়যন্ত্র করে আলোচনায় থাকতে চাইছে।
বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে কিংবা প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী দোসরদের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, যতক্ষণ আওয়ামী লীগ গণহত্যা, হত্যাকান্ড ও দুর্নীতির জন্য ক্ষমা না চায়, তাদের দোষী নেতাকর্মীরা বিচারের মুখোমুখি না হয় এবং যতদিন পর্যন্ত দলটির বর্তমান নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদী আদর্শ থেকে বের না হয়ে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বেশির ভাগ নেতাকর্মী গা ঢাকা দেন। তাদের অনেকেই পাশের দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন। গ্রেফতারও হয়েছেন শত শত। গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে কয়েক শ’ মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা, ১৮ তারিখ হরতালের ডাক!
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ফলে, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে ছাত্রলীগের কোনো বৈধ কর্মসূচি পালনের সুযোগ নেই। মঙ্গলবার রাতে দলটির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দাবির লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি করবে দলটি। ৬ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। ১৬ ফেব্রুয়ারি রোববার অবরোধ এবং ১৮ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক 'কঠোর' হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে, বিজ্ঞপ্তিতে দলটির সংশ্লিষ্ট কোনো নেতা-কর্মীর স্বাক্ষর ছিল না।
সরকার পতন ও এত মানুষ হত্যার পর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রধান সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘এত মানুষ হত্যা করার পরও শেখ হাসিনা কিভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেন? যে দেশে এত হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, সেখানে এলে তো ফাঁসির মঞ্চে ঝুলতে হবে। শেখ হাসিনা দেশে আসলে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলবে বলেও এ সময় মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক।’
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবার ১০ নবেম্বর নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। শহীদ নূর হোসেনের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিও সঙ্গে নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। ১০ নবেম্বর জিরো পয়েন্টের কাছেও ভিড়তে পারেনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী। দিনভর স্থানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিরোধীদের দখলে ছিল। অনেকে এটাকে জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের জিরো পারফরম্যান্স হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে অনেকটা চুপসে যায় আওয়ামী লীগ। অনলাইনে গুজব ছড়ানো ছাড়া তাদের কোথাও সক্রিয় দেখা যায়নি।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জসহ দেশের অল্প কিছু জায়গায় দলটির নেতা-কর্মীদের মিছিল করতে দেখা গেলেও, সেটি ছিল ঝটিকা মিছিল। মিছিলে অংশগ্রহণকারী অনেকেরই মুখ ঢাকা ছিল। কোনো কোনো মিছিলে ১০ জনের বেশি নেতা-কর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ বলেন, আওয়ামী লীগের উচিত জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নিজের ভুল স্বীকার করা। এখনো আমি তাদের আত্মসমালোচনা বা ক্ষমা চাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখিনি।
সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, গণহত্যার দায়ে সংশ্লিষ্ট ফ্যাসিবাদী দলগুলো আর রাজনীতিতে ফিরতে পারেনি। শুধু জার্মানি বা ইতালিই নয়, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও বিভিন্ন সময় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। এদের বেশির ভাগকেই পরবর্তী সময়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ হিসেবে আওয়ামী লীগেরও আর রাজনীতিতে ফিরতে পারার কথা নয়। সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চললে এবং ড. ইউনূস যা বলছেন, তা বাস্তবায়িত হলে দলটির বেশির ভাগ নেতা, আওয়ামী লীগ আমলে দায়িত্ব পালন করা অনেক আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাই গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। শুধু ব্যক্তিই নন, দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ দোষী প্রমাণিত হয়ে সাজার মুখোমুখি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই গণতান্ত্রিক ছিল না। প্রতিবারই শাসনক্ষমতায় গিয়ে টোটালিটারিয়ান টাইরান্টের চরিত্র ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন একপেশে হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে নতুন দল গঠিত হবে। পূর্ববঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রধান দুই দল ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের সুর ধরতে না পারার কারণে ১৯৪৭ এর পর কংগ্রেস ছিল না। সেই শূন্যতা পূরণ করেছিল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা শক্তির নাম উল্লেখ করেননি। তার এই বক্তব্যে দলের ব্যর্থতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা আরও অনেক বিশ্লেষকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে।
আওয়ামী লীগের শাসনের পতন ও তাদের পরিণতির ধরনটা এবার ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া ৭৫ বছর বয়সী দলটির জুটেছে ফ্যাসিবাদের তকমা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন আওয়ামী লীগের এই পরিণতি, এর কারণ বা বাস্তবতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে তারা।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ৬ মাস পার হয়েছে। এখন পর্যন্ত দলটির নেতা-কর্মীদের চিন্তায় বা কথায় কিন্তু কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিতও নেই। এমনকি দলটির নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে সে ব্যাপারেও তাদের কোনো বিকল্প চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ গণঅভ্যুত্থান ও তাদের সরকারের পতনকে এখনো একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে।
এরই মধ্যে দলটির বিদেশে পালিয়ে যাওয়া কোনো কোনো নেতা অডিও-ভিডিও বক্তব্য ছেড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে; কেউ কেউ বিবৃতি দিয়েছেন। দেশী-বিদেশী পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, এটাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের মূল বিষয়।
তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার কয়েকটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এই ফোনালাপগুলো যদি আসল হয়ে থাকে, তাহলে আমরা দেখব তার কথাবার্তা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন নেই। এসব ফোনালাপে ক্ষোভ ও ক্রোধেরই প্রকাশ ঘটেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের ক্ষমা চাওয়ার ওপর এবং তাদের বর্তমান আদর্শ পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের শাসনামলের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
ড. ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের শাসনকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করে তা পুনর্গঠনের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের রীতিনীতি একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। টানা তিন মেয়াদে ভোটারবিহীন ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা। আর তাতে তিনি নিজেকে এবং তার দলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। একজন ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে এসব করেছেন হাসিনা। ’শুধু জুলাই বিপ্লবের হত্যাযজ্ঞই নয়, গত ১৫ বছরের গুম, বিনা বিচারে হত্যারও বিচার করা হবে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন যতই হম্বিতম্বি করুক বা রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিক না কেন, আওয়ামী লীগের পরিধি ছোট হয়ে আসতে পারে যদি ছাত্ররা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চান। ছাত্রদের দিক থেকে এ বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ রয়েছে।