জাতীয় বাংলাদেশ
ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
ছেলে বাড়ি এলো লাশ হয়ে
আসিফের প্রতিবেশীরা জানান, আসিফের লাশের দাফন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার বাদ জুমা। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ১৮ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তার মরদেহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার ফজরের নামাজের পরপরই বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। লাশ আসার খবর প্রতিবেশী কিংবা গ্রামের মানুষ জানার আগেই তাকে দাফন করতে হয়।
মুহাম্মদ নূরে আলম: শহীদ আসিফ হাসানের বাবা এখন একরকম বাকরুদ্ধ। বসে থাকেন বাড়িতে অথবা বাড়ির পাশের মসজিদে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন সামনের দিকে। ফিসফিস করে বললেন, ‘ওকে বাড়ি চলে আসতে বলেছিলাম। টাকা পাঠালাম। এলো, তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে।’ আসিফের বাবার নাম মাহমুদ হাসান। তিনি আগে চিংড়ি চাষ ও ব্যবসা করতেন। এখন তেমন কিছু করেন না। নিরিবিলি সময় কাটান বাড়িতে। মা শিরিন বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘আমার আসিফ কোনো অন্যায় করতে পারে না। ওকে কেন তোমরা মেরে ফেললে? ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। ওকে লেখাপড়া করাতে বিদেশে পাঠাব। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৮ জুলাই ২০২৪ বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলীতে মারাত্মক আহত হন আসিফ হাসান। দুপুর ১২টার দিকে তাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পরপরই আসিফের নিহত হওয়ার খবর বাড়িতে আসে। খবর ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়স্বজনসহ আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ বাড়িতে আসতে থাকেন। আসিফদের বাড়ি সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। শহীদ আসিফ হাসান ২০০৩ সালে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের আস্কারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের সবুজে ঘেরা বিশাল বাড়িতে বড় হয়েছেন আসিফ। তিন বোনের পর আসিফ হাসান ও রাকিব হাসান যমজ দুই ভাই। ছোটবেলা থেকে মেধাবী। পাশের নলতা হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও নলতা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন তিনি। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। শহীদ আসিফ হাসান গ্রাম থেকে উঠে আসা এক ফুটফুটে কিশোর, যাকে কেউ চিনতো না। চেনার মতো বয়সও তার হয়নি। কিন্তু জুলাই বিপ্লবে শহীদ হয়ে আসিফ হাসান কিংবদন্তী হয়ে থাকবেন দেশের মানুষের মনে।
নতুন প্রজন্মের কিংবদন্তী: ১৮ জুলাই ২০২৪ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলী ছোড়ে পুলিশ। এখানে ছররা গুলীতে গুলীবিদ্ধ হন আসিফ। বুকটা একেবারেই ঝাঁঝরা, মাথার ডান পাশে গুলী লাগে। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। আসিফ হাসানকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পিতামাতা ও বন্ধুদের অভিব্যক্তি: মা শিরিন বেগম আহাজারি করে বলছেন, বাবা, তোরে নিষেধ করলাম। বললাম, ও আব্বা তুমি যাইও না যেন, আব্বা তা-ও গেছে। আমার আসিফ চলি গেছে। আসিফ বাবা আর নেই। আসিফের স্কুলশিক্ষক আবুল হাসান বলেন, আসিফ খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। রাজধানীর নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল সে। খুব মেধাবী। শিক্ষাঙ্গনে এভাবে রক্তাক্ত এবং ছাত্রদের বুকে গুলী আমরা এমন মৃত্যু দেখতে চাই না। আমরা হত্যার বিচার চাই। আসিফ হাসানের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামে দলে দলে তার বাড়িতে আসছেন আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ নিকটজনরা। আসিফের বাল্যবন্ধুরাও অনেকে এসেছেন। বন্ধুকে হারিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তারা।
স্মারক: শহীদ মো. আসিফ হাসান-এর অবদানকে চিরস্বরণীয় করে রাখার জন্য এবং শহীদ মো. আসিফ-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাজার নাম ‘‘শহীদ আসিফ চত্ত্বর’’ নামকরণ করা হয়েছে! আমাদের অধিকার রক্ষার জন্য এরকম অনেক আসিফ আড়ালে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছে। যাদের ব্যপারে আমরা কখনোই জানতে পারব না। যাদেরকে নিয়ে কখনোই আলোচনা হবে না। যাদের কোনো ভিডিও ফুটেজ ধারণ করা হয়নি। যাদের কেউ কখনো সোশ্যাল মিডিয়াতে হাইপে রাখেনি। গোপনে ঝরে যাওয়া এমন সহস্র শহীদ বীরদের প্রতি রইলো আমার অজস্র সালাম।
আসিফের প্রতিবেশীরা জানান, আসিফের লাশের দাফন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার বাদ জুমা। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ১৮ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তার মরদেহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার ফজরের নামাজের পরপরই বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। লাশ আসার খবর প্রতিবেশী কিংবা গ্রামের মানুষ জানার আগেই তাকে দাফন করতে হয়।
আসিফ চত্বরের’ স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বেসরকারি নর্দান ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আসিফ হাসান। তার স্মৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে ‘আসিফ চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মঙ্গলবার দুপুর দুইটায় ‘আসিফ চত্বর’-এর স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। এসময় দোয়া ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন শহিদ আসিফের গর্বিত পিতা মাহমুদ আলম, মাতা, ভাই, ফুফু সহ পরিবারের সদস্যরা।
আলোচনা অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন. শহীদ হওয়াটা যখন গৌরবের ও মর্যাদার, তখন বেঁচে থাকাটা অপরাধের মনে হয়। তিনি বলেন, আসিফসহ অন্যান্য শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশকে সংস্কার করা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অবদান ও আত্মত্যাগ বিশেষ করে আসিফের আত্মত্যাগকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য নর্দান ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে আমরা সেটাকে স্বাগত জানাই।