DailySangram-Logo

সম্পাদকীয়

বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসনের পর গত বছরের ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছে।

Printed Edition

প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসনের পর গত বছরের ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। সেদিন ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তিনিসহ তার দলের মন্ত্রী-এমপিরাও অনেকেই দেশ ছাড়েন। যারা দেশ ছাড়তে পারেন নি তারা চলে যান আত্মগোপনে। আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধও হয়েছেন।

মূলত, প্রায় দেড় যুগ ধরে আওয়ামী শাসনামলে দেশের কোন স্বাধীন সত্তাই ছিলো না। ক্ষমতাসীনরা বিনাভোটে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য আমাদের স্বাধীন সত্তার এক প্রকার অপমৃত্যুই ঘটিয়েছিলো। সাবেক সরকারের পররাষ্ট্রনীতি শুধু নতজানুই ছিলো না বরং ছিল একদেশদর্শী। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জাতীয় স্বার্থ বিক্রি করে সবকিছু একটি দেশকে উজাড় করে দেয়। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলেও ট্রানজিট-করিডোরসহ সবকিছু হাতিয়ে নিয়েছে নিকট প্রতিবেশী। এ বিষয়ে পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রীতিমত আত্মস্বীকৃতিও রয়েছে। যা তার আত্মপ্রতারণার দলিল হিসাবেই বিবেচিত আত্মসচেতন মানুষের কাছে।

এক অনিবার্য বাস্তবতায় জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী ক্ষমতার ছন্দপতন হওয়ার পর দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রতিবেশীরা যারপর নেই ব্যথিত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ যতটা না শোকাহত হয়েছে তারচেয়ে অধিক মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছে বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাই তারা ছাত্র-জনতার এ বিজয়কে বিতর্কিত ও নস্যাৎ করার জন্য বিপ্লবী সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে। সে ধারাবাহিকতায় পরিকল্পিতভাবে দেশের সীমান্তকে অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। জিকির তোলা হয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের। সে জ¦ালানো আগুনে ঘি ঢেলে দেয় একশ্রেণির ভারতীয় গণমাধ্যম। মিথ্যা, বানোয়াট ও যোগসাজশী খবর প্রকাশ করে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিচক্ষণতা ও সময়োচিত বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের কারণে সেসব মোটেই হালে পানি পায়নি বরং বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশীরাই অনেকটা ব্যাকফুটে পড়েছে।

এরপরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কূটনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, বাংলাদেশের ওপর ভারতের চাপ প্রয়োগের কৌশল প্রায় পুুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দিল্লী ঢাকাকে তিনটি কঠোর শর্ত দিয়েছিল, এসবের মধ্যে ছিল শেখ হাসিনার শর্তযুক্ত প্রত্যর্পণ, ভারতীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ করা এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু এসব দাবিতে বাংলাদেশকে দমানো যায়নি বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী দেশকে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং অন্য কোনো দেশের আধিপত্য মেনে নেওয়া হবে না। ভারতের এ হস্তক্ষেপমূলক নীতি শুধু কূটনৈতিকভাবে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। যা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের জন্য রীতিমত চপেটাঘাত বলেই মনে করছেন বোদ্ধামহল।

মূলত, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বৈরী অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে কাশ্মীর, সীমান্ত সংঘর্ষ ও নিরাপত্তা ইস্যুগুলোতে দেশ দু’টি সব সময়ই মুখোমুখি অবস্থানে। এ উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন উষ্ণতা ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ, যা দিল্লীর জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফর এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ সফর প্রমাণ করে, দু’দেশের মধ্যে নতুন সমঝোতা গড়ে উঠছে। ভারত যদি বাংলাদেশকে চাপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়, তবে এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকেও বদলে দেবে। যা ভারতের জন্য মোটেই ইতিবাচক হবে না।

বাংলাদেশ এখন নতুন বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য বিকল্প খুঁজছে এবং পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য অংশীদার হয়ে উঠছে। চীন, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও নতুন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি মোকাবিলায় এ কৌশল দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে। ভারত যদি বাংলাদেশকে শত্রুর চোখে দেখে, তবে বাংলাদেশও কৌশলগতভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং নতুন জোট তৈরি করে আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এখন এক নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে নিজের পথ নির্ধারণ করবে, কোনো পরাশক্তির ছায়ায় নয়। আর এটিই হচ্ছে বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্্রনীতি। যে নীতির সাথে এদেশের মানুষ একাত্ম ও একাকার।

কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতি যদি স্বাধীন না হয় তাহলে সেদেশকে পুরোপুরি স্বাধীন দেশ বলার কোন সুযোগ থাকে না। বিগত প্রায় ১৬ বছরে সে অশুভ বৃত্তেই আটকা পড়েছিলো দেশ। আওয়ামী রেজিমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শুধু নতজানুই ছিলো না বরং জানুকাটা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সে খোলস থেকে ইতোমধ্যেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ফলে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। যা জনগণের ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন। দেশের মানুষ নতুন সরকারের কাছে সবক্ষেত্রেই ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করে।