সম্পাদকীয়
বিমানকে সুস্থ করুন
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কখনো কোনো অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞকে বিমানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা।
Printed Edition
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই; গর্ব করতে চাই বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসকে নিয়েও। কিন্তু বিমানকে ‘অথর্ব প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে মন্তব্য করলেন কেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ? আর যেখানে সেখানে নয়, গত সোমবার রাজধানীতে অর্থনৈতিক বিষয়ক টাস্কফোর্সের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করলেন। তার শব্দচয়ন থেকে উপলব্ধি করা যায় বিমানের ওপর তিনি কতটা বিরক্ত হয়ে আছেন। একটি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চললে তো বিরক্ত হওয়ার কারণ থাকে না। বিমান অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার বড় কারণ লুটপাট। তাই প্রশ্ন জাগে, এ লুটপাটের কারিগর কারা? টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বিমানকে ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই সরকারি সচিব বিমান বাহিনী অথবা সামরিক বাহিনীর লোকেরা বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাথে ছিল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কখনো কোনো অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞকে বিমানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা।
বিমানের বয়স তো কম হলো না। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিমানের যাত্রা শুরু। ২০০৭-০৮ মেয়াদে ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিমানের ফ্লিটকে আধুনিকায়নের জন্য বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। বিমানের বহরে তখন যুক্ত হয় নতুন প্রজন্মের ১২টি আধুনিক বোয়িং উড়োজাহাজ। সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুরস্কারস্বরূপ এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দীনকে বিমানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার মিগ-২৯ মামলার সাক্ষী। তার মাধ্যমে বিমানের অর্থ লুটপাট ও লিজ বাণিজ্য শুরু হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দু’টি প্লেন লিজ নেয় বিমান। বছর পার না হতেই বিমান দু’টির ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ওই ইঞ্জিনগুলো ছিল ১২-১৫ বছরের পুরোনো। ইজিপ্ট এয়ার থেকে ইঞ্জিন ভাড়ায় এনে সচল করা হয় একটি উড়োজাহাজ। অপরটিকে বসিয়ে রেখে লিজের টাকা পরিশোধ করতে হয় বিমানকে। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় সচল প্লেনটিও। এতে পাঁচ বছরে দেশের ক্ষতি হয় ১২০০ কোটি টাকা। একাদশ জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তদন্তে এসব বিষয়গুলো উঠে আসে।
বিমানের একজন পাইলট জানান, সরকারি সচিবরা টিকেট কাটেন ইকোনমি ক্লাসে অথচ ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে টিকেট বাবদ বিমানের পাওনা রয়েছে কয়েক কোটি টাকা। বিমানের রুট প্ল্যানিং নিয়েও রয়েছে অদক্ষতা। বিমানের পরিচালনা পরিষদের যারা মেম্বার, তারাও অ্যাভিয়েশনে দক্ষ নন। আর এখন যারা টাস্কফোর্সের সদস্য তারাও নাকি একই মুখ, ঘুরেফিরে। সময়ের আবর্তনে ঘুরেফিরে এরাই বিমানের বোর্ড সদস্য, বিমানের পরিচালক আর মহাব্যবস্থাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। এটাই হয়ে এসেছে, এটাই হচ্ছে এখনো। সংশ্লিষ্ট পাইলট আরো বলেন, বিমানে দীর্ঘ বছর কাজ করে এটাই আমার সারমর্ম। বোর্ড মিটিংয়ে যখন বোর্ড মেম্বার প্রশ্ন করেন, বিমানের দু’টি ইঞ্জিন কেন আপনারা এক সঙ্গে চালু রাখেন, তখন নিজেকেই অথর্ব লাগতো।’ উপলব্ধি করা যায়, বিমানে শুধু দুর্নীতি হতো না, দেশের স্বার্থও জলাঞ্জলি দেওয়া হতো। এছাড়া অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ লোকদের সমাবেশ ঘটেছিলো প্রতিষ্ঠানটিতে। নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের ঘাটতিও ছিল সেখানে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাবে কেমন করে, তার তো টিকে থাকাই মুশকিল। এ কারণেই হয়তো পরিকল্পনা উপদেষ্টা বিমানকে একটা অথর্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তবে এখানে বলার মত বিষয় হলো, শুধু মন্তব্যের মাধ্যমে তো প্রতিষ্ঠানের সংকট কাটবে না। এর সুষ্ঠু চিকিৎসা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে বিমানের অসুস্থতার মাত্রা বেড়েছে। আগের সরকারগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে বিমানকে সুস্থ করে তুলতে পারলে তা জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তেমন দৃশ্য আমরা দেখতে পারবো কী?