সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ নয় বিপাকে ভারত
আগস্ট বিপ্লবের পর আমাদের বৃহত প্রতিবেশী ভারত মনে করেছিলো তারা বাংলাদেশকে রীতিমত বেকায়দায় ফেলতে পারবে।
Printed Edition
আগস্ট বিপ্লবের পর আমাদের বৃহত প্রতিবেশী ভারত মনে করেছিলো তারা বাংলাদেশকে রীতিমত বেকায়দায় ফেলতে পারবে। সে লক্ষ্যে দেশটি তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসার দরজা বন্ধ করে দেয়। রপ্তানি বাণিজ্যেও নানাবিধ বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। ভারতীয় মিডিয়াগুলোতেও বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার তুঙ্গে ওঠে। দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বায়বীয় কাহিনী প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। একাজে ইন্ধন যোগায় ভারতের উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে অর্জিত বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে।
তবে তাদের কোন ষড়যন্ত্রই সফল হয়নি বরং বাংলাদেশ আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। ফলে বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলতে গিয়ে প্রতিবেশীই বেশি সমস্যায় পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশীদের ভিসা বন্ধ করার কারণে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের চিকিৎসা কেন্দ্র, হাসপাতাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ব্যবসা ও বিপনী কেন্দ্র সহ ব্যবসা কেন্দ্রগুলো রীতিমত বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আলু-পেঁয়াজ সহ পচনশীল কৃষিপণ্য বাংলাদেশের রপ্তানি সীমিত হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। এমনকি সময়মত বিক্রি না হওয়ার বিভিন্ন কৃষি পণ্য পচে নষ্ট হওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে শায়েস্তা করতে গিয়ে এখন নিজেদেরই লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। ভারতীয় রুপীর রেকর্ড দরপতন দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের কপাল খুললেও যেন কপাল পুড়েছে ভারতের। বিষয়টি নিয়ে তাদের আত্মস্বীকৃতিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের অবনতি। তাহলে কি জুলাই বিপ্লবের পরই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের নেয়া সিদ্ধান্তেরই খেসারত দিতে হচ্ছে মোদিকে? এমন প্রশ্নই এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টিকে অনেকেই যৌক্তিক মনে করছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে এ মুহূর্তে ভারতের সম্পর্ক মোটেই স্বাভাবিক নয় বরং এখন রীতিমত তলানীতে এসে ঠেকেছে। বিশেষ করে ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে ভারতের অর্থনীতি একটি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে পর্যটক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতের পর্যটন শিল্পে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশীদের ভারতীয় ভিসা বন্ধ করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছে ভারত। কারণ ভারতে ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে প্রায় শীর্ষে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত বাংলাদেশীদের ভ্রমণ ভিসা বন্ধ করায় দেশটির পর্যটন খাত ইতোমধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ভারতের পর্যটন খাতে প্রতিবছর প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। যার মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলার আসে শুধুমাত্র বাংলাদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে। বাংলাদেশী পর্যটকরা ভারতের মোট বিদেশী পর্যটকদের ২২ শতাংশ। আর ভিসা ফি থেকেও ভারতের আয় হতো প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু সে আয় এখন একেবারেই শূন্য। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে. ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন বাংলাদেশিরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রেক্ষিতে সাময়িক ভিসা প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। তার প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্য খাতেও। কেয়ারেজ রেটিং রিপোর্ট অনুসারে ভারতের মোট চিকিৎসা পর্যটনে শতকরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ অবদান রাখে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এদিকে বাংলাদেশের পর্যটকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে কার্যত ধুকছে নিউমার্কেট চত্বর। মধ্য কলকাতার প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় ১০০টি হোটেল এবং ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার দোকান রয়েছে যেগুলো পুরোপুরিভাবে নির্ভর করে এই বাংলাদেশী পর্যটকদের উপরে।
সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে গিয়ে এবং বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সেসব বাংলাদেশের জন্য সাপেবর হয়েছে। দেশটি কৃষিপণ্য রপ্তানি সীমিত করায় আমরা ইতোমধ্যেই বিকল্প পথে হাঁটা শুরু করেছি। চিকিৎসার জন্য নতুন ভাবনা শুরু হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ খানিকটা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে গিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যা দেশটিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তাই বৃহত প্রতিবেশী ভারতের উচিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করা। অন্যথায় উভয় দেশের মধ্যে আগামী দিনে বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।