সম্পাদকীয়
গুমের সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ লজ্জাজনক
বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ আমলে দেশজুড়ে নানা অপরাধ ও অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের এবং বিরোধী মতের মানুষগুলোকে আওয়ামী লীগ যেভাবে দমন করেছে, অত্যাচার করেছে তা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্ব ইতিহাসেই নজিরবিহীন।
Printed Edition
বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ আমলে দেশজুড়ে নানা অপরাধ ও অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের এবং বিরোধী মতের মানুষগুলোকে আওয়ামী লীগ যেভাবে দমন করেছে, অত্যাচার করেছে তা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্ব ইতিহাসেই নজিরবিহীন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। আবার গুমকৃত ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সংস্থার অধীনে নানা স্থাপনা তৈরি করে সেখানে আটক রেখে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে। পরিবারগুলো সরকারের কাছে নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধান জানতে চাইলে সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। অনেকক্ষেত্রেই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ভিকটিম পরিবারগুলোর আপনজন হারানোর দাবিকে মিথ্যা ও নাটক বলে অভিহত করেছেন। উপহাসও করা হয়েছে নানাভাবে।
অথচ গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর অনেক সত্যই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। আওয়ামী সরকার কতটা নৃশংসভাবে গুমের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেছিল সে কথাগুলো ভিকটিম ও তাদের পরিবারগুলোই খোলাসা করতে শুরু করেছেন। আয়নাঘরের সন্ধান মিলেছে। গুমের ভিকটিমদের দীর্ঘসময় আটক থাকার বিবরণীর সাথে আয়নাঘরের কাঠামোর মিল পেয়েছেন গুম সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিশন। এমনই যখন পরিস্থিতি, তখনই আরেকটি বড় ধরনের খবর মঙ্গলবার বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।
খবরে জানানো হয়, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গুমের ঘটনা তদারকিতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কয়েকজন শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গুমের ঘটনা তদারকিতে যুক্ত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আফটার দ্য মনসুন রেভ্যুলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ গুম করে রাখার বিষয়ে অবগত ছিলেন। হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর, গোপন আটক কেন্দ্র থেকে তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং এই তিনজনের বিষয়ে আওয়ামী সরকার বছরের পর বছর ধরে তাদের আটক রাখার কথা অস্বীকার করে আসছিল। গুম হওয়ার শিকার আইনজীবী মীর আহমাদ বিন কাসেম জানিয়েছেন, তাকে যে স্থানে আটক রাখা হয়েছিল তা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে এখানে আটক ব্যক্তিরা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, নির্যাতনের ধরন শুধু পদ্ধতিগত নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিকও ছিল।
রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অনেক সময় অনেক কথা বলেন। প্রতিপক্ষকে নানা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুম ও খুনের সাথে আওয়ামী লীগ এবং দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অনেক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষও এসব অভিযোগের সত্যতা বিশ্বাস করেন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও আন্তর্জাতিক একটি মানবাধিকার সংস্থা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যখন বাংলাদেশের পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে গুমের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, তখন এটি আমাদের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। এইচআরডব্লিউ কোনো ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান নয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রভাবিত হয়ে কোনো কাজ করে না। তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে বলেই তারা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে এই ধরনের ন্যক্কারজনক অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
এ রিপোর্ট আমাদের দেশের নীতি নির্ধারণী মহল বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের জন্য বড়ো ধরনের একটি শিক্ষা। ক্ষমতা চিরস্থায়ী কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করলে একজন দুর্দান্ত প্রতাপশালী ব্যক্তিকেও শুধুমাত্র জাতীয়ভাবে নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিসরেও লাঞ্ছিত হতে হয়-এইচআরডব্লিউ এর প্রতিবেদন সেই প্রমাণই বহন করে। তাই এ ঘটনা থেকে ভবিষ্যৎ শাসকগোষ্ঠীকে শিক্ষা নেওয়া দরকার।