সম্পাদকীয়
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড : যৌক্তিক পরিণতির আশাবাদ
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার তৎকালীন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
Printed Edition
গত ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ১৩ বছর অতিবাহিত হলো। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার তৎকালীন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৩ বছর পার হলেও এ হত্যা মামলার তদন্ত হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দেওয়া নিয়ে কেবল সময়ই চেয়েছেন।
নির্মম হত্যাকা-ের পর প্রথম ছয় বছর, অর্থাৎ ২০১২-১৮ পর্যন্ত র্যাবের তদন্তের ফল ছিল ‘শূন্য’। আওয়ামী লীগ সরকার এ হত্যাকা-ের বিচারের জন্য আন্তরিক ছিল না তা মোটামুটি স্পষ্ট। ফলে, কেন হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়েছিল সে রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নতুন নতুন তারিখই কেবল ধার্য হয়েছে। এ পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়েছে ১১৫ বার। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিগত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন অভিমত দিয়েছেন। বর্তমানে মামলার তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিলে এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। পরে বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যক্তিকে তারা গ্রেফতারও করে। মামলার সব আলামত যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছিল র্যাব। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএ নমুনাও যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। পরে এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন র্যাবের কাছে আসে। হত্যার ঘটনায় বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ১৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব; কিন্তু খুনি শনাক্তের জন্য কার্যকর ক্লু পায়নি।
সাগর-রুনি হত্যাকা-ের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামীদের গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য দিতে পারব বলে আশা করছি।’ কিন্তু এরপর আরো দুই মেয়াদ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও এ হত্যাকা-ের রহস্যের কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি। এমনটা হওয়া অবধারিতই ছিল। কেননা পতিত আওয়ামী সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন, “সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে।” ভিকটিম পরিবারগুলো মনে করে, এ হত্যাকা-ের পেছনে বড় কেউ রয়েছে। তাই এতদিন এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। যদি সাধারণ কোনো চোর বা ডাকাত এটি করত, তবে অনেক আগেই এটি প্রকাশ পেত।”
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রমে গতি সঞ্চার হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে ২৩ অক্টোবর পিবিআই প্রধানকে নিয়ে চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করারও নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ হত্যা মামলার বর্তমান আইনজীবী শিশির মনির জানিয়েছেন, ১৩ বছরেও হত্যা রহস্য উন্মোচন না হওয়া রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। তবে মামলার তদন্তে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। অতীতে উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। যারা বাধা দিয়েছিলেন, তাদের নাম তদন্তে উঠে আসবে। অনেককে চিহ্নিত করা গেছে। তাই আশার আলো দেখা যাচ্ছে।”
আমরা আইনজীবীর কথায় আশ^স্ত হতে চাই। আশা করি, আগামী বছর সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ১৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার আগেই এ হত্যাকা-ের প্রকৃত খুনীদের নাম আমরা জানতে পারবো এবং তাদের বিচারিক প্রক্রিয়াও দেখতে পাবো। একইসাথে, আমরা এও প্রত্যাশা রাখতে চাই, নির্মম এ হত্যাকা-ের পর ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ সরকার কেন এর রহস্য উদঘাটন করলো না, সে সত্যও জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে। এ অনীহার নেপথ্যে আওয়ামী লীগের দুরভিসন্ধি জানতেও জনগণ আগ্রহী। আমরা নতুন করে আশাবাদী হতে চাই অন্তর্বর্তী সরকার চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-টির একটি যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছুতে সক্ষম হবে।