সম্পাদকীয়
মত অভিমত
বিভেদ নয় ঐক্যেই বিজয়
গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখানে মত থাকবে; দ্বিমতও থাকবে। এভাবে সমাজ এগিয়ে যাবে, লাভবান হবে দেশ। রাজনীতিতে উত্তাপ দেখা দেয় মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্য ঘিরে। বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এ সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না।
Printed Edition
॥ জান্নাতি মোবাশ্শারা ॥
দেশের রাজনীতির ময়দানে হঠাৎ করেই কিছুটা উত্তাপ দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখানে মত থাকবে; দ্বিমতও থাকবে। এভাবে সমাজ এগিয়ে যাবে, লাভবান হবে দেশ। রাজনীতিতে উত্তাপ দেখা দেয় মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্য ঘিরে। বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এ সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। কিন্তু তারা যদি মনে করেন সরকারে থেকে নির্বাচন করবেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো সেটা মেনে নেবে না।
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের জবাবে সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১ সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।
তিনি আরো বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার জাতীয় সরকার না হলেও সরকারে আন্দোলনের সব পক্ষেরই অংশীদারত্ব রয়েছে এবং সব পক্ষই নানা সুবিধা ভোগ করছে। সরকার গঠনের আগেই ৬ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পুলিশের আগের আইজির নিয়োগ হয়েছিল যারা মূলত বিএনপির লোক। এরকমভাবে সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানান স্তরে বিএনপিপন্থী লোকজন রয়েছে। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার কথা বললে এ বাস্তবতায়ও মাথায় রাখতে হবে।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে তা আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে হয়েছে। এখানে যেমন বিএনপির সম্মতি ছিল তেমনি ছিল জামায়াতে ইসলামী ও অপরাপর ডান-বাম এবং ইসলামী দলগুলোর। সেদিন সবাই গণভবনে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কার প্রতিনিধি কিংবা অন্য উপদেষ্টারা কার প্রতিনিধি হয়ে সরকারে শপথ নিচ্ছেন সেদিন সে প্রশ্ন কেউ তোলেননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে ছাত্ররা রাজনীতি করছেন। এটি তারা করতেই পারেন। রাজনৈতিক দল করা ছাত্রদের অধিকার। ছাত্রদের দল গঠন প্রক্রিয়ার সাথে তাদের প্রতিনিধি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারে থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে তারাও। উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করতে চাইলে সরকার থেকে বের হয়েই করবেন। একই সাথে রাজনৈতিক দলেরও সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। বিভিন্ন সরকারি/সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে তদবির/চাপ প্রয়োগ করা অনুচিত।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ৫ আগস্টের পর থেকে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের এক ধরনের বৈরী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হচ্ছে নানাভাবে। তাদের চলাফেরায় মানুষের একটু ভালোবাসার পরিমাণ বেশি হলেই তা নিয়ে রীতিমতো ঠাট্টা-মশকরা করা হচ্ছে। এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে আসিফ, নাহিদ, সারজিস আলম, মহিন ও হাসনাত আব্দুল্লাহরাই সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের নেতৃত্বেই তো সারাদেশে সমন্বয়করা সেদিন জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছিলেন! তাহলে ছাত্র সমন্বয়করা কয়েক মাসে কী এমন করল যে, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে হবে?
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরিবেশ দীর্ঘদিন থেকেই তৈরি হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার ভূমিকা আছে। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরেই ইতিবাচক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এসব রাজনৈতিক দল সাহস করে মাঠে নেমে বারবার আন্দোলন গড়ে তুললেও সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। সর্বশেষ তারা ব্যর্থতার পরিচয় দেন ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর, যার ফলে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একটি একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন।
আরো অপ্রিয় সত্য হলো, গত সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের ক্ষেত্রে বিদেশী শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল খুব দুঃখজনক। শেখ হাসিনা দেশে একের পর এক বিনা ভোটে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন আর প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো তার সাথেই কাজ করে গেছে। ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করলে এশিয়ার একটি দেশের রাষ্ট্রদূত তাকে স্বর্ণের নৌকা উপহারও দিয়েছিলেন!
গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের আওয়ামী প্রেমী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্সক্ষার অনুকুলে দাঁড়াতে পারেনি। শেখ হাসিনা দেশে একের পর এক গণহত্যা চালিয়েছেন, গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের আওয়ামী প্রেমী এসব উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নীরব ভূমিকায়ই থেকে গেছে।
ঠিক এমন একটি অবস্থায় ছাত্ররা যে আন্দোলন গড়ে তুলে শেখ হাসিনার পতন ঘটাল সেজন্যে ছাত্রদের তো সাদরে মাথায় তুলে রাখার কথা। অথচ ঘটছে উল্টোটা। তাদের নিয়ে বিষোদগার, কুৎসা রটানো ও দ্বন্দ্বে জড়ানো হচ্ছে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেখানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার চালানো গণহত্যার বিচার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, নাৎসি বাহিনীর মতো আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা তোলার দরকার ছিল, সেখানে ছাত্রদের সাথে দল গঠন করা নিয়ে দ্বন্দ্ব ফ্যাসিবাদীদের রাজনীতিতে ফেরার পথ তৈরি করে দেবে বলেই মানুষের বিশ্বাস।
রাজনীতিতে গেলে ভুলভ্রান্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ছাত্রদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু তাই বলে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের সামান্য ভুলত্রুটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মাঠের রাজনীতিতে যেভাবে তাদের নাস্তানাবুদ করা হচ্ছে তা অনাকাক্সিক্ষত। ছাত্রদেরও মনে রাখা দরকার, দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যেসব প্রতিষ্ঠিত বড় রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে তাদের অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এসব বড় বড় রাজনৈতিক শক্তির ভুল ধরা যেতে পারে কিন্তু তাদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা শোভন নয়।
সাধারণ মানুষের কাছে ছাত্ররা জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাদের সাহস, ত্যাগ আর কুরবানির কারণে। জীবন বাজি রেখে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অনেকে লড়াই করলেও ছাত্ররা সামনে এসে লড়াই করার পরেই কেবল হাসিনার স্বৈরশাসনের যবনিকাপাত হয়েছে। গণতন্ত্রকামী মানুষ মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। ফলে ছাত্রদের নামটা এখন একটু বেশিই মানুষের মনে গেঁথে গেছে। সবাই তাদের ভালোবাসছেন। এ ভালোবাসা আর জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে বিএনপির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ফ্যাসিবাদ-উত্তর নতুন বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে রাজনীতির মাঠ নতুন ফুল ও ফসলে ভরে উঠুক সেটিই মানুষ প্রত্যাশা করে। একই সাথে দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সবাই যেমন ঐক্যবদ্ধ ছিল, তেমনি ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই মানুষ পছন্দ করে। মনে রাখতে হবে বিরোধ কিংবা বিভেদ নয়, ঐক্যেই বিজয়।
লেখক : ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সৈনিক।