সম্পাদকীয়
ঢাকা অপরিচ্ছন্ন নগরী
ঢাকা শহরের ইতিহাস ঐতিহ্য চার শত বছরের। রাজধানি ঢাকা এখন যানজট ও অপরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিণত হয়েছে। ২০২৪-এর হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা হলো ২ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন।
Printed Edition
॥ এইচ এম আব্দুর রহিম ॥
ঢাকা শহরের ইতিহাস ঐতিহ্য চার শত বছরের। রাজধানি ঢাকা এখন যানজট ও অপরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিণত হয়েছে। ২০২৪-এর হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা হলো ২ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশী জনঘনত্বপূর্ণ মহানগরী। ঢাকা মহানগরীর আয়তন ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার। প্রতিবর্গ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে ২৩ হাজার লোক বাস করে। ঢাকা শহরের মোট রাস্তার পরিমাণ হলো প্রায় ২৪.৪৮বর্গ কিলোমিটার। যা প্রয়োজনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। ঢাকায় মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার। প্রয়োজন ৭৬.৫ বর্গ কিলোমিটার। যানজটের কারণে ব্যক্তির কর্মঘন্টার প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় যাতায়াতে নষ্ট হয়। প্রত্যক্ষভাবে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি হয় । টাকার অঙ্কে জিডিপির ক্ষতি হয় ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। সড়ক প্রয়োজন ৭৬ দশমিক ৫ বর্গ কিলোমিটার সেখানে আছে ২৪ দশমিক ৪৮বর্গ কিলোমিটার। প্রয়োজনের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ সড়ক নেই। ঢাকা শহরে প্রায় ১২ লাখ রিকশা চলাচল করে। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ৬০ লাখ মানুষ। যা শহরের মোট জনসংখ্যার এক- চতুর্থাংশ। যুগের আধুনিকায়নের জন্য রিকশা গুলোতে ব্যাটারি লাগানো হচ্ছে। গত ১৯ শে নবেন্বর উচ্চ আদালত থেকে ঢাকা মহানগর এলাকায় তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশে বলা হয় ঢাকা মহানগর দুই সিটি করপোরেশন, স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপিকে দ্রুত এই ব্যবস্থাটি কার্যকর করার জন্য। ঢাকা শহরে প্রায় ৬ লাখ প্রাইভেটকার চলাচল করে। নগরের ৪৫ ভাগ সড়ক এই প্রাইভেটকারদের দখলে। রাজধানি শহরে ১১ লাখ মটর সাইকেল চলাচল করে। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে দেশের জিডিপির ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এখন বসবাসের অনুপযোগীর দিক দিয়ে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭ তম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী যানজটের কারণে রাজধানির ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এই শহরের মানুষের হার অনুপাতে সবুজ জায়গা কিংবা ওপেন স্পেসের পরিমাণ ৯০ ভাগের ১ ভাগ।
শহরের জনঘনত্ব, পরিবহন ব্যবস্থা, যানজটের মাত্রা পরিবেশ দূষণ, সবুজের সমারোহ, নাগরিকদের আর্থিক অবস্থান, শারিরিকও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, কর্মঘন্টার প্রয়োগসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা তৈরি করে জিপজেট। শহর, দূষণ, অর্থ ও মানুষ- এই চারভাগে ১৭ টি মাত্রায় ১০ নবেন্বরের মধ্যে পয়েন্ট দিয়ে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ঢাকার পরপরই আছে করাচি, নয়াদিল্লি ও ম্যানিলা। গড় হিসাবে ১৫০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৪৪তম। ১০-এ ১ পেয়ে জার্মানির স্টটগার্ট শহরটি কম চাপ সৃষ্টিকারী শহরের মর্যাদা পেয়েছে। অর্থাৎ শান্তিতে বসবাস করার জন্য এ শহরটি সেরা।
মসজিদের শহর ঢাকা এখন পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ, ময়লা আর্বজনায় পরিণত হয়েছে। চর্তুদিকে নদীবেষ্ঠিত ঢাকায় এক সময় বিদেশি বণিকেরা আসতেন। শহর ছিল পরিচ্ছন্ন, নদী, নালা-খাল-বিল ও বনায়নে ভরপুর। এই শহর এখন অভিশপ্ত নগরিতে পরিণত হয়েছে। লক্কড় ঝক্কড় বাস। যেখানে সেখানে পার্কিং করে যাত্রী উঠানামা হচ্ছে। সবখানে যেন এক বিশৃংখল পরিবেশ। দেখার যেন কেউ নেই। অথচ নাগরিকদের সেবার বালাই নেই। কংক্রিটের এই শহরে যেভাবে বহুতল ভবনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে সেই পরিবেশ বিনষ্টের প্রক্রিয়া চলছে। যত্র তত্র ময়লার ভাগাড় এখন চিরচেনা দৃশ্য। সড়কের দৃশ্য দেখলে মনে হয় এটা রাজধানি শহর নয় ডাম্পিং স্টেশন। ৫০ বছর আগে ঢাকা ছিল সবুজের সমারোহ। সেই সবুজ এখন আর নেই। ছিল অসংখ্য খাল, নালা, জলাশয়। ১৯৯২ সালে এ শহরের ৯২ বর্গকিলামিটারের বেশী এলাকা ছিল সবুজ। ২০০২ সালে এর পরিমাণ কমে দাড়ায় ৩১ বর্গ কিলোমিটার। আসলে ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে বিকশিত হওয়ায় এ শহর থেকে শুধু সবুজ বিদায় নিয়েছে। এ ছাড়া রাজধানির বাসীর দুর্ভোগের শেষ নেই। ঢাকা উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশীর ভাগ সড়কই এখন ভাঙাচোরা একদিকে খানা খন্দক অন্য দিকে এবড়ো থেবড়ো। বেশ কিছু সড়কের অবস্থা বেহাল। অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়া খুঁড়ি করার কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি যেন ছাড়ছে না।
ঢাকার ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তি, ভাড়া বাসাসহ ভীষণভাবে অস্থায়ী বাসস্থানে বসবাস করে। বাসস্থানের সঙ্গে নেই বিনোদনে সুযোগ। শহর সুস্থ্য থাকলে, ভালো থাকলে তার নাগরিকেরাও মননে রঙিন হবে, মন প্রফুল্ল হবে এটাই স¦াভাবিক। ঢাকার এ দুর্দশার প্রধান কারণ হলো, ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ঢাকা পেয়েছে মাত্র ২৬.৮। এই ক্ষেত্রে এত কম নন্বর ১৪০টা শহরের মধ্যে আর কোন শহর পায়নি। দামেস্ক পেয়েছে ৩২.১। আর করাচি পেয়েছে ৫১.৮ অর্থাৎ ঢাকায় প্রায় দ্বিগুণ। এর মানে হলো, আমাদের প্রিয় রাজধানি ভৌত অবকাঠমোর পরিমাণ গতও গুণগতমান পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ। ভৌত কাঠামো বলতে বোঝানো হয়েছে, রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা, পার্ক, হাটা চলার জায়গা পয়োনিষ্কাশন ও পানি নিষ্কাশনের নালা-নর্দমা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ সব ধরনের নাগরিক সেবার সঞ্চালন লাইন। কোন নগরের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্য এগুলো অপরিহার্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রেই ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এতটা খারাপ যে এই শহর কে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। জনসংখ্যা যানবাহনের তুলনায় পর্যাপ্ত রাস্তা ঘাটের অভাবে ফলে ঢাকা এখন পৃথিবীর ধীরগতি মহানগর। যান জটের কারণে এই শহরের যানবাহনের গতি কমতে কমতে এখন মানুষের হাটার গতির সমান হতে চলেছে। অবিরাম স্নায়ুর পীড়নে মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণে দেখা দেয় নানা ধরণের অপ্রীতিকর অসংগতি। পর্যাপ্ত সংখ্যক নালা-নর্দমা ও পানি নিষ্কাশনের অভাবে এক ঘন্টা বৃষ্টিতেই এই মহানগরের অনেক এলাকা জল মগ্ন হয়ে পড়ে।
ঢাকার যেখানে যাবেন সেখানে দেখতে পাবেন আবর্জনার স্তূপ। কিন্তু আবর্জনা রাখা হয় কন্টেনারের ভেতরের চেয়ে বাইরে বেশী। ফলে আবর্জনা গুলো রাস্তায় পড়ে থাকে। কয়েকদিন পর পর কনটেইনারগুলোর ময়লা নিয়ে ফেলা হয় শহরের যেখানেই ফাঁকা পাওয়া যায় সেখানেই। তাই সৌন্দর্য পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তা থেকে অনবরত নির্গত গন্ধে মানুষের বিভিন্ন জটিলও স্থায়ী ব্যধি সৃষ্টি হচ্ছে। মশামাছির বিস্তার ঘটছে ব্যাপক। ড্রেন বন্ধ হওয়ার কারণ হলো পলিথিনের ব্যাগ ও যত্র তত্র গড়ে উঠা তরিতরকারির দোকানোর বর্জ্যও নির্মাণ সামগ্রী তথা বালি, সিমেন্ট ও ইটের ভগ্নাংশ। এগুলো ড্রেনের মধ্যে ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এগুলো রাস্তার ধারে রাখা নিষিদ্ধ। অপর দিকে প্রতিটি বাসায় ময়লা নেওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে। এ জন্য তারা প্রতি মাসে টাকাও নেয়। শর্ত প্রতি দিন ময়লা নিতে হবে। কিন্তু তারা এই শর্ত পালন করে না। নিয়ে যায় সপ্তাহের দুই এক দিন। ফলে প্রতিটি বাসার মধ্যে আবর্জনার স্তূপ সৃষ্টি হয়ে যায় রাস্তার মতই। চরম দুর্গন্ধও সৃষ্টি হয়। পুরানো ঢাকার অবস্থা আরো খারাপ। উপরন্তু আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজ যতটুকু করা হয় তাও দিনের বেলায়। মানুষ যখন কাজে যায় তখন। ময়লা পরিবহনের বড় বড় গাড়িগুলো ময়লা নিয়ে যায় দিনের বেলায় তাও আবার রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে অসংখ্য পথচারির নাকের ডগার উপর দিয়ে।
নগরীর খেলা ধুলার স্থান প্রয়োজনের তুলনায় কম। বেশ কয়েকটি পার্ক আছে। সেগুলো যানবাহন মাদকসেবী আর বখাটে লোকে ভরপুর। তাই সাধারণ লোক সেখানে যায় না। জলাবদ্ধতা রাস্তা দখল, অপরিকল্পিত ও জরাজীর্ণ বাড়ীঘর, ব্যাপক চাঁদাবাজী, নিরাপত্তা হীনতা, ভয়াবহ যানজট ইত্যাদি বিদ্যমান। অনেক দলের নেতা-নেত্রী, এমপি, মেয়র, মন্ত্রী আমলারা তথা নামিদামি সবাই তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার কথা বলেন অহরহ। আর নির্বাচন এলে কথাই নেই। সকলেই বিশ্বের সেরা শহরে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।