DailySangram-Logo

সম্পাদকীয়

আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী

আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী হলেও আগস্ট বিপ্লবের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে।

Printed Edition

আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী হলেও আগস্ট বিপ্লবের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে। আমদানি-রপ্তানি সীমিতকরণসহ সীমান্ত পরিস্থিতি এখন রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে। ফলে বাংলাদেশকে নতুন মিত্রের সন্ধানের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বোদ্ধামহল। যদিও বাংলাদেশ এখনো এ বিষয় নিয়ে পুরোপুরি উদাসীন। কিন্তু ভারত মনে করছে দেশটির সাথে বড় ধরনের সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। যা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে খানিকটা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় এক সামরিক বিশেষজ্ঞ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অস্বস্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, চীন ও পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে পারে। তাই নয়াদিল্লিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে স্থিতিশীল করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। দি প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে ভারতীয় জেনারেল প্রকাশ মেনন বলেছেন, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চীন ও পাকিস্তান। বাংলাদেশকে তার দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য ভারতের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং কৌশলগত হাতিয়ার ব্যবহার করা উচিত। চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব এবং ক্রমবর্ধমান পাকিস্তান-বাংলাদেশ নৈকট্য এবং তিনটি দেশের সাথে ভারতের অবনতিশীল সম্পর্ক হুমকির মূল কারণ। এছাড়াও, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। যদিও ভারত-চীন সম্পর্ক মেরামতের প্রচেষ্টা চলছে। তবে মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ছায়ায় সম্পর্কের অবস্থা জিম্মি থাকবে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে।

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এ সামরিক বোদ্ধার ধারণা চীনের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্টতই আশা করা যায়। আমেরিকার সাথে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের প্রচেষ্টা বিবেচনা করে, ভারতকে বাংলাদেশের সাথে তার ক্রমবর্ধমান নৈকট্য কীভাবে কাজে লাগায় সে সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জেনারেল প্রকাশ মেননের শঙ্কা চীন বাংলাদেশের সাথে তার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের ছিদ্রযুক্ত সীমান্তকে কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং মণিপুরে। মণিপুরের চলমান জাতিগত সংঘাত এ ধরনের চক্রান্তের জন্য উর্বর ভূমি। ভারতকে যথাসময়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলেতে শত্রুতামূলক কার্যকলাপের জন্য পাকিস্তান এবং চীন উভয়ই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে তা মোকাবেলা করতে হতে পারে।

তার ভাষায়, ভারত বাংলাদেশের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আশা করতে পারে। অবশ্যই দেশটি যে প্রকৃত পথ গ্রহণ করবে তা এ বছরের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের পরে পরিলক্ষিত হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মন্থন ভারতের হুমকির পরিধিকে প্রসারিত করছে এবং তৃতীয় মহাদেশীয় ফ্রন্ট তৈরি করতে পারে। সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মেনন মনে করেন, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমন্বয় সম্ভাব্যভাবে একটি গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি যা ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীদের প্রথমে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শোষণের জন্য উৎপাদিত ক্ষেত্র সৃষ্টির বিরুদ্ধে নজর দিতে হবে।

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন যে, নবনিযুক্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। যদিও তিনি কোনও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেননি। তবে আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা ভারতের উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়। মেননের অস্বস্তির কারণ বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত ভূমিকা পালনের ফলে নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তার প্রথম বিদেশ সফর করেন এবং বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সাথে দেখা করেন। বাংলাদেশের সাথে হাত মেলাতে এবং ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিতে, কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করতে এবং কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে চীনের প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মন্তব্য করেন যে, চীনের সাথে বন্ধুত্ব বাংলাদেশে একটি আন্তঃদলীয় ঐকমত্য, যা পরবর্তী সরকার এবং সমগ্র জাতি দ্বারা সমর্থিত। তবে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের চীন সফর নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করেননি জেনারেল মেনন। বিষয়টি রহস্যজনকই মনে করছে কূটনৈতিক বোদ্ধামহল।

মূলত, বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। কারো সাথে বৈরিতা নয় বরং সকলের সাথে সুস্পর্ক বজায় রেখেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হয়েছে। তবে বিগত প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে তদানীন্তন সরকার ভারত বিষয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে তা কোন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হতে পারে না। পতিত সরকারের নতজানু ও দাসপ্রবণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে আমরা জাতীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। প্রবিবেশী দেশ ভারত আমাদের কাজ থেকে অনেক কিছু নিয়ে গেলেও বিনিময়ে আমরা কিছুই। আর পতিত সরকার ভারতকে খুশী রাখতেই একটি আজ্ঞাবাহী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে।

নতুন সরকার সে বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতবিরোধী নয় বরং সকলের সাথে সমতা ও ইনসাফের ভিত্তিক। তাই কারো সাথে আমাদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হলে তা ভারতের জন্য মোটেই উদ্বেগের কারণ নয় বরং আমরা সকলের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।