সম্পাদকীয়
ক্যাম্পাসে শান্তি বজায় রাখতে হবে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে ভয়াবহ জুলুম ও নিপীড়ন সহ্য করেছে। গেস্টরুম ও গণরুমে অসংখ্য ছাত্র নির্যাতিত হয়েছে, টর্চার সেলে হতাহতের শিকার হয়েছে। ক্যাম্পাসে দাদাভাই, বড়োভাইদের দৌরাত্ম্য সহ্য করেছে। ভর্তি বাণিজ্যের ভিকটিম হয়েছে।
Printed Edition
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে ভয়াবহ জুলুম ও নিপীড়ন সহ্য করেছে। গেস্টরুম ও গণরুমে অসংখ্য ছাত্র নির্যাতিত হয়েছে, টর্চার সেলে হতাহতের শিকার হয়েছে। ক্যাম্পাসে দাদাভাই, বড়োভাইদের দৌরাত্ম্য সহ্য করেছে। ভর্তি বাণিজ্যের ভিকটিম হয়েছে। শহীদ আবরারদের মতো মেধাবি ছাত্ররা একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নেশা আর অস্ত্রের ভয়াবহ প্রদর্শনী ও অনুশীলন দেখেছে। ক্যাম্পাসে সাধারণভাবেও চলাচলের সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে মারা গেছে। কেউ কেউ আবার ট্যাগিং-এর রাজনীতির ভিকটিম হয়েছে।
সরকারী দলের লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র সংগঠন ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনকে যথাযথভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত না হলে কাউকে হলে সিট দেয়া হয়নি। ক্যাম্পাসগুলোতে এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র চালু করা হয়েছে যেখানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া আর কারোই কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সরকারের বিরোধিতা করলে সাধারণ যে কোনো ছাত্রছাত্রীর ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছে। ছাত্রীদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ছাত্রী হোস্টেল বা হলগুলোর ভেতরও এক ধরনের পৈশাচিকতন্ত্র পরিচালনা করা হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই যে, সাড়ে ১৫ বছরের এসব জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে করতে ছাত্র-ছাত্রীরা হাঁপিয়ে উঠেছিল এবং তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। ছাত্ররা ফ্যাসিবাদী আমলেও বারবার গর্জে উঠেছে। কখনো ট্রাফিক আইন সংস্কারের জন্য আবার কখনো বা কোটা প্রথা বিলুপ্তির জন্য। আর ২০২৪ সালে এসে সে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা বিরোধী আন্দোলন একটি পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্টে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটে। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে তাই ছাত্রজনতার ভূমিকাই যে মুখ্য এমনটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
যে ছাত্রজনতা এতবড়ো একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললো, বিপ্লব পরবর্তী সরকারের আমলে সে ছাত্রজনতার স্বার্থ ও নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অনেকক্ষেত্রেই ছাত্রদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করা হয়েছে। বিপ্লবের সুবিধাভোগীরা পর্যন্ত ছাত্রজনতাকে অপরিপক্ক আখ্যা দিয়ে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রদের এতবড়ো একটি আন্দোলনের পর তাদেরকে যেভাবে গাইড করার প্রয়োজন ছিল, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো তা করতে পারেননি বরং প্রশাসনিক মন্থরতা ও রাজনীতিবীদদের রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ ছাত্রজনতার সাথে তাদের দূরত্ব কেবল বৃদ্ধিই করেছে।
আমরা আশংকা করছি, এর খেসারত যেন আমাদেরকে না দিতে হয়। ইতোমধ্যেই ক্যাম্পাসগুলোতে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিপ্লবের পরপর ক্যাম্পাসগুলোতে কিছু মব নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও আন্দোলনকারী ছাত্রদের দৃঢ়তায় তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অধীনস্ত ছাত্র সংগঠনগুলোকে আগের মতো করেই পরিচালনা করতে চেয়েছে। এসব ছাত্র সংগঠন দীর্ঘদিন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করতে অভ্যস্ত হওয়ায় তারাও এর বাইরে যেতে পারছে না। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে এবং ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষায় যা যা করা দরকার- বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই তা করতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার একটি দাবি ছিল। কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলো তা করতে চাইছে না। তাদের আশংকা, এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলো এর ফায়দা নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনেও আওয়ামী বিরোধী লোকদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তারাও অনেকক্ষেত্রে পূর্বের প্রশাসনের মতোই দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন যা দুঃখজনক। যেসব ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ সেখানেও ভিন্ন কোনো মোড়কে ছাত্র রাজনীতির সূত্রপাত যেন না হয় তাও নিশ্চিত করা জরুরি। সবারই অনুধাবন করা উচিত যে, দেশে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে আর বিপ্লবের পর কোনো কিছুই আগের মতো করে করার মানসিকতা লালন করা উচিত নয়। বরং ছাত্রদের স্বার্থে যা করা প্রয়োজন অবিলম্বে তা করতে হবে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেই হবে।