DailySangram-Logo-en-H90

সম্পাদকীয়

ভোজ্যতেলের বাজার

ভোজ্যতেলের শুধু অভ্যন্তরীণ বাজার নয় বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও অস্থিরতা দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে সার্বিক পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। সে ধরাবাহিকতায় অভ্যন্তরীণ

Printed Edition

ভোজ্যতেলের শুধু অভ্যন্তরীণ বাজার নয় বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও অস্থিরতা দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে সার্বিক পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। সে ধরাবাহিকতায় অভ্যন্তরীণ বাজারেও বেশ উত্থান-পতন লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। ভোজ্যতেল পরিশোধনকরী দেশীয় কারখানাগুলোর মালিকেরা সরকারকে জানিয়েছেন, অন্যান্যবারের তুলনায় এ বছর আমদানি পরিস্থিতি ভালো। তারপরও বোতলজাত ভোজ্যতেলের সংকট চলছে। কিন্তু কেন তা হচ্ছে, সেটি তারা জানেন না।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) কার্যালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা বিষয়ক এক বৈঠকে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তাতে ভাসা ভাসা কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও যথাযথ কোনো সমাধান হয়নি বলে জ্ঞাত হওয়া গেছে। ফলে ভোজ্যতেল নিয়ে মূল সংকট থেকেই যাচ্ছে। বিটিটিসির সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। দেশের শীর্ষ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নিয়েছেন।

বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিটিটিসি জানিয়েছে, বাজারে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই। যেটি হয়েছে তা কৃত্রিম সংকট এবং প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থেকে তা সৃষ্ট। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ঋণপত্রও (এলসি) বেড়েছে একই হারে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববাজারেও এখন পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও বিপণনের সব পর্যায়ে বাজার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।

কেউ কেউ অন্যান্য পণ্য কেনার শর্তে ভোজ্যতেল বাজারজাত করছে, এমন তথ্য উঠে এসেছে বৈঠকে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উৎপাদক বা কোনো পর্যায়ে এ ধরনের শর্তযুক্ত বিক্রি বা বাজারজাত করা প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভোক্তারা জানিয়েছেন, অনেক দিন ধরেই ভোজ্যতেল নিয়ে সমস্যা চলছে। কিন্তু বাজার তদারকিতে তা ধরা পড়ছে না। পড়লেও সেটি চেপে যাওয়া হচ্ছে। ছদ্মবেশে বা ক্রেতা সেজে বাজারে ঢুকলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যারা এটি করছে, তারা সরকারের বাজার তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ভোজ্যতেল পাচার বা এর অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য নিয়েও কথা উঠেছে বৈঠকে। প্রতিবেশী দেশে মূল্য বেশি হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হচ্ছে কি না, সীমান্তসংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও সংস্থাগুলোকে তা খতিয়ে দেখতে এবং তা প্রতিরোধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বৈঠকে আরও বলা হয়েছে, নিজেদের পরিবেশকদের কাছে সরবরাহ করা ভোজ্যতেল ভোক্তারা সব সময় নির্ধারিত দামে কিনতে পারছেন কি না, তা ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই তদারক করবে।

বিষয়টি নিয়ে পরিশোধন কোম্পানিগুলো খোলামেলা কথা বলেছেন। সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি বৈঠকে জানিয়েছেন, তারা গত জানুয়ারিতে মোট ৫০ হাজার ৭০০ টন ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছেন। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৪২ টন বোতলজাত। এর আগের মাস ডিসেম্বরে তারা ১৪ হাজার ২৬২ টন বোতলজাত ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছিলেন। এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জানুয়ারিতে তাঁরা মোট ৪৭ হাজার ৬৬৮ হাজার টন সরবরাহ করেন। এরমধ্যে ১৫ হাজার টন বোতলজাত। আগের মাসের ২৫ হাজার টনের মধ্যে ১২ হাজার টন ছিল বোতলজাত। টি কে গ্রুপের পরিচালক জানাচ্ছেন, জানুয়ারিতে তারা ১১ হাজার ৮১০ টন বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেন, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ৫০০ টন। অন্যান্য উৎপাদনকারীরা জানাচ্ছেন, তারাও আগের মাসগুলোর তুলনায় সম্প্রতি বেশি তেল সরবরাহ করেছেন। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অভিমত হচ্ছে, রমযান উপলক্ষে এখন পাইপলাইনে প্রায় দেড় লাখ টন ভোজ্যতেল ভর্তি জাহাজ চট্টগ্রামের বন্দরে নোঙর করার অপেক্ষায় আছে। এ তেল শিগগিরই সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত হবে। ব্যবসায়ীরা আরও জানাচ্ছেন, মাঠপর্যায়ে কেউ অতিরিক্ত মজুত করে থাকতে পারেন। আবার কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় বোতল কেটে খোলা তেলে পরিণত করে তা বিক্রি করতে পারেন। বিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। তবে রমযানে চাহিদা বেশি, ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ টন।

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বাজারে ভোজ্যতেলের কোন সঙ্কট নেই বরং মহলবিশেষ অতি মুনাফার আশায় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্ট করছে। সক্রিয় রয়েছে একটি বাজার সিন্ডিকেট। পতিত সরকার সংশ্লিষ্টরা একাজে তৎপর রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন। মূলত, আসন্ন রমযানকে সামনে রেখে বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। মূলত, আমাদের দেশের অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল মনিটরিং-এর কারণে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। তাই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় আসন্ন রমযান মাসে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা যাবে না।