DailySangram-Logo

কলাম

পতিতদের স্বপ্নবিলাস

১৯৭১ সালে দুগ্ধজাত শিশু হওয়ায় স্বাধীনতা বা যুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি আমার। পরবর্তীতে যখন বুঝতে শিখেছি তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানামুখী গল্পগাঁথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।

Printed Edition

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

১৯৭১ সালে দুগ্ধজাত শিশু হওয়ায় স্বাধীনতা বা যুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি আমার। পরবর্তীতে যখন বুঝতে শিখেছি তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানামুখী গল্পগাঁথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যত প্রকার মত-অভিমত, ভিন্নতা, বৈচিত্র্য ও বৈপরিত্য শুনেছি, বিশ্বের অন্যকোন ঐতিহাসিক ঘটনায় এ ধরনের এমনটা আমার চোখে পড়েনি। বিষয়টি আমাকে বেশ অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। মূলত অজানাকে জানা এবং সত্যানুসন্ধান আমার স্বভাবজাত।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের অপশাসন-দুঃশসনের কথা নানা জনের মুখে নানাভাবে শুনেছি। ইতিহাস পড়ে তো সত্য উপলব্ধির সুযোগ খুবই কম আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কারণ, সরকার পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেশের ইতিহাসেরও পরিবর্তন হয়। তাই আমি প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি বরাবরই। কিন্তু এক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে হতাশ হতে হয়েছে। কারণ, তারা প্রায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেন। তবে আমি একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসাবে সবকিছু সমন্বয় করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এ বিষয়ে আমার উপলব্ধিতে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে; তবে তা যে আমার অসাধুতা নয় তা বলতে পারি প্রত্যয়ের সাথেই।

স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের কথা আমরা বরাবরই শুনে থাকি। এরমধ্যে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান ভারতীয় সংবিধানে অনুলিপি বলে অভিযোগ করা হয়। যা ছিলো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আগেব-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা ঘটনা কারো অজানা নয়। রাষ্ট্রায়াত্ত ৪টি পত্রিকা বাদে সকল গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো আওয়ামী-বাকশালী আমলে। সিরাজ শিকদার সহ ভিন্ন মতাবলম্বী ত্রিশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিলো বাকশালী রেজিমে। কিন্তু এসব আমার রীতিমত শোনা কথা। তাই বিষয়টি নিয়ে কারো মনে সন্দেহ-সংশয় থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আর ইতিহাস জানার প্রবল আকাক্সক্ষা থেকে এসব অনুসন্ধান করে চলেছি। কিন্তু তা এখনো শেষ হয়নি।

১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় এসেছিলো। তবে আমি আওয়ামী-বাকশালীদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলাম সম্ভবত ২০১০ সালে। সেদিন অবিভক্ত ঢাকা মহানগরী জামায়াতের উদ্যোগে মহানগরী সেক্রেটারি ও তদানীন্তন এমপি এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ এবং সহকারী সেক্রেটারি নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি ছোট মিছিল মতিঝিল শাপলা চত্বরে গিয়ে মাত্র ২/১ মিনিটের সমাবেশের মাধ্যমেই শেষ হয়েছিলো। এরপর সাথে সাথেই শুরু হয় সাদা পোশাকধারী বাকশালী লাঠিয়াল বাহিনীর তাণ্ডব। মিছিলকারীরা প্রায়ই নিরাপদ প্রস্থান করলেও বেধড়ক পিটুনীর শিকার হন সাধারণ পথচারি ও মতিঝিলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে নিস্ব হয়ে পড়েন। তখন মনে হয়েছিলো এটিই যদি গণতন্ত্র হয় তাহলে স্বৈরতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? মূলত এটিই ছিল আওয়ামী গণতন্ত্রের নমুনা।

এরপর দীর্ঘ ১৬ বছরের অপশাসন দুঃশাসন আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ও আওয়ামী গণতন্ত্রের কথা কারো অজানা নয়। আওয়ামী লীগ দেশকে মেধা ও নেতৃত্বশূণ্য কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে দেশকে রক্তাক্ত ও বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলো। রাজপথে বিরোধী দলের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অঘোষিতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এমনকি ঘরোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে ভিন্নমতের লোকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দিয়ে কথিত রিমান্ডের নামে নির্মম ও নিষ্ঠুরতা চালানো হয়। এতেও বিরোধী দল দমন করতে ব্যর্থ হয়ে কথিত ক্রস ফায়ারের নামে সারাদেশেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এ বিষয়ে একজন মন্ত্রীর চাঞ্চল্যকর আত্মস্বীকৃতিও রয়েছে। সে সময় বিরোধী দল নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্য গণহারে শুরু করা হয় গুম-অপহরণ। বেআইনিভাবে আটক রেখে নির্যাতন করার জন্য দেশের বিভিন্নস্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয় আয়না ঘর। ফলে গোটা দেশই পরিণত হয় আওয়ামী-বাকশালীদের রাম রাজ্যে। পুরো দেশই পরিণত হয় অঘোষিত কারাগারে।

বিগত প্রায় ১৬ বছর ধরে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথের বিরোধী দলগুলো সরকার পতনের জন্য বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন গড়ে তুললেও মাফিয়াতন্ত্রীরা সেসব আন্দোলনে গুলী চালিয়ে নির্মমভাবে দমন করে। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে বাকশালীদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যুগপৎ ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা এ আন্দোলন দমনের জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলী চালিয়ে প্রায় ২ হাজার মানুষ হত্যা করে। কিন্তু এরপর ছাত্র-জনতার উত্তাল তরঙ্গ বন্ধ করা যায়নি বরং রাজপথের আন্দোলনের তীব্র হতে তীব্রতর হলেও আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। কারণ, জনগণ অনেক আগেই তাকে ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকে তালাক দেওয়ায় তার পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আর এটিই ছিলো আওয়ামী-বাকশালীদের জন্য নির্মম বাস্তবতা। কারণ, শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে ‘তালাক’ দেয়া ছাড়া দেশ ও জাতির কাছে কোনই বিকল্প ছিল না। তাই সে পর্যন্ত তা-ই ঘটেছে।

মূলত, আওয়ামী লীগের অপশাসন-দুঃশাসনের কারণেই তারা অনেক আগেই জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়েছে। রসিক জনেরা বিষয়টিকে তালাক হিসাবেই বিবেচনা করছেন। কারণ, তারা দলীয় পশুশক্তি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধ ব্যুহ তাসের ঘরের মত উড়ে গেছে। বাস্তিল দুর্গের সকল প্রতিরোধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাদের নেত্রীকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে। বস্তুত, কোন রাজনৈতিক সরকারের উত্থান-পতন নতুন কিছু নয়। কিন্তু কোন সরকারের পতনের পর সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী সহ সকল মন্ত্রী-এমপি পলায়নের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে খুবই নজীরবিহীন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান পালানোর ঘটনাও ঘটেছে। এতে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কতটা গণধিকৃত ছিলো। আশা করা হয়েছিলো যে, দেশ জাতির সাথে গাদ্দারী, দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দাফন-কাফন এবং নির্মম গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু কয়লা ধুলে যে ময়লা যায় না তার বাস্তব প্রমাণই হলো আওয়ামী লীগ। তারা অতীত অপকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা বরং পতনের পর নানা বেশ ধরে এবং বিভিন্ন আঙ্গিতে দৃশ্যপটে আসার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন, কখনো আনসার বিদ্রোহ; কখনো গার্মেন্টস শ্রমিকের ভান করে; আবার কখনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর বেশ নানা ধরনের ছদ্মবেশ ধারণ করে দৃশ্যপটে আসার চেষ্টা চালিয়েছে। অবশ্য তারা কোন ক্ষেত্রেই সফল হয়নি বরং বারবারই জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়েছে।

তারপরও এদের দেশ ও জাতিস্বত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি বরং পলাতক আওয়ামী নেত্রী ভারতের নিরাপদ স্থান থেকে মাঝে মাঝে হুংকার দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। ‘চট’ করে দেশে ঢোকার ঘোষণার পরও আওয়ামী লীগের অনলাইন একটিভিষ্টরা আগামী মার্চ ও অথবা এপ্রিলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েই দেশে ফিরবেন বলে ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়। এ বিষয়ে অনলাইনে আওয়ামী বীর আস্ফালন রীতিমত বেড়ে যায়। শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর জন্য মহাবীরদের আদলে তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা ও তার দলের লোকেরা মনে করেছিলো যে, মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এদেশের আত্মভোলা ও সরল-সাদা মানুষ আওয়ামী অপকর্ম, অপশাসন-দুঃশাসনের কথা ভুলে গেছে। তারা শেখ হাসিনাকে নতুন করে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তত হয়েছে। তাই আওয়ামী নেত্রী নতুন করে স্বপ্ন বিলাসে মেতে উঠেছেন। ভারতের নিরাপদ স্থান থেকে দলের সন্ত্রাসী নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য অনলাইলে বক্তব্য দেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু এদেশের মানুষের যে এখনো স্মৃতিভ্রম ঘটেনি তা প্রমাণিত হয়েছে ৩৬ আর ৩২ একাকার হওয়ার মাধ্যমে। যদিও তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। কারণ, এদেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও তার দলকে স্থায়ীভাবেই তালাক তথা তিন তালাক বায়েন করে দিয়েছে। কিন্তু মাফিয়া নেত্রী ও তার দল তা উপলদ্ধিই করতে পারেনি। যেমন উপলদ্ধি করতে পারেন নি ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র মনসুর বয়াতি রচিত ‘দেওয়ানা মদীনা’ পালার আখ্যান চরিত্র ‘মদীনা সুন্দরী’। পুত্র তালাক দেয়ার পর তার অভিব্যক্তি-

‘তালাকনামা যখন পাইল মদীনা সুন্দরী

হাসিয়া উড়াইল কথা বিশ্বাস না করি

আমার খসম না ছাড়িব পরান থাকিতে

চালাকি করিল মোরে পরখ করিতে’॥

মদীনার সুন্দরীর সরল বিশ্বাসের জন্য তাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। আর শেখ হাসিনার হঠকারিতা তিনি ও তার দলের রাজনৈতিক কবর রচনা করবে। আর পতিতদের স্বপ্নবিলাস এদেশে আর কখনোই বাস্তবায়িত হবে না! মূলত এটিই বাস্তবতা।