কলাম
রাশিয়ায় যুদ্ধদাস প্রসঙ্গে
দেশ থেকে প্রতিনিয়ত কিছু মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য, কেউ অর্থবিত্ত উপার্জন করার জন্য; যা সত্যিই দেশের জন্য কল্যাণকর।
Printed Edition
অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন
দেশ থেকে প্রতিনিয়ত কিছু মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য, কেউ অর্থবিত্ত উপার্জন করার জন্য; যা সত্যিই দেশের জন্য কল্যাণকর। এর বাইরে কিছু মানুষ লোভের ফাঁদে পড়ে বিদেশমুখী হচ্ছে, যা খুবই বেদনাদায়ক। যারা ইউরোপে যাচ্ছে তাদের একটি অংশ কখনো ভূমধ্যসাগরে, কখনো গহীন জঙ্গলে কিংবা যুদ্ধদাস হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বিদেশমুখী হওয়া কি অপরাধ? তারাও দেশের অথনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ থেকে ২০২৩ সালে ১৩ লাখের অধিক কর্মী বিদেশে গেছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)র ভাষ্যমতে ২০২৩ সালে ১৩ লাখ সাত হাজার ৮০৫ জন কর্মী বিশ্বের ১৩৭ টি দেশে গেছেন যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি মানুষ কাজের সন্ধানে দেশ ছেড়েছেন। (সূত্র : ০৫ জানুয়ারি, কালের কন্ঠ, ২০২৫) এ মানুষগুলোর রেমিট্যান্স টাকায় আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। কারণ ২০২২ সালে তাদের অবদান ছিল প্রায় ৫.৬৪ শতাংশ। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রবাসী আয় এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ দেশে এসেছে, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের নতুন রেকর্ড হয়েছে। পুরো বছরে দেশে এসেছে মোট প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এসেছে ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, যা এক মাসের রেমিট্যান্সের রেকর্ড এবং আগের বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। (সূত্র : ডেলি স্টার বাংলা, জানুয়ারি-১, ২০২৫) প্রবাসীদের আয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত মুদ্রা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও যেনতেন উপায়ে বিদেশযাত্রা বন্ধ করা প্রয়োজন।
উন্নত জীবনের সন্ধানে, মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যায়। কারণ একটাই একটু ভালো থাকা, একটু ভালো খাবার খাওয়া, একটু সখ আহ্লাদ পূরণ করা। তবে অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়া অপরাধ। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের কিছু মানুষ লোভে পড়ে, প্রতারণার ফাঁদে পড়ে, হঠাৎ বড়লোক হওয়ার মনোবাসনায় সবকিছুই মনের অজান্তে বিলিয়ে দেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া আত্মহত্যার শামিল। তারপরও ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাকালে প্রায় ২৫০০ জনের বেশি অভিবাসী মানুষ মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যমতে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। প্রতিবছর অবৈধভাবে এ সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে গড়ে নৌকাডুবিতে ৫০০ বাংলাদেশীর মৃত্যু ঘটে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে প্রায় ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৪ জন বাংলাদেশি। এর ভেতর বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতি ঘন্টায় দেড়শ বাংলাদেশী দেশ ছাড়ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএমইটি ছাড়পত্র নেওয়া কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৭ জন। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ প্রবাসে যায়। ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি নারী পুরুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। প্রতি বছর শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ লাখের। তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় মজুরি ভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে। দেশে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান না পাওয়ার ফলে শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত তরুণরা বিদেশমুখী।
গত ২৮ জানুয়ারি কালের কন্ঠে প্রকাশিত ‘রাশিয়ায় যুদ্ধে আট বাংলাদেশী’ শিরোনামে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভাষ্য থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় মানবপাচারের একটি বড় ধরনের ফাঁদ পেতেছে ড্রিম হোম ট্রাভেলস নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান। গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্তরে তাদের একটি চক্র রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় প্রতিটি পয়েন্টে দালাল চক্রের সদস্য কাজ করছে। দালালচক্রের সদস্যরা বিদেশগামীদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে এক থেকে দেড় মাস সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের মাঠে ঠেলে দেয়। দালালচক্র মালি বা বাবুর্চির কাজের কথা বলে জনপ্রতি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এবং ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে ১৫ থেকে ১৮ লাখ হাতিয়ে নেয়। রাশিয়ায় যুদ্ধদাস বানানোর কারিগর ড্রিম হোম ট্রাভেলস। এর চেয়ারম্যান নড়াইলের বাসিন্দা এম এম আবুল হাসান। তিনি নড়াগাতী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। (সূত্র : কালের কন্ঠ, ২৮ জানুয়ারি,২০২৫) অর্থের লোভ ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধদাস হিসেবে মানুষকে বিক্রি করে দেয়া গুরুতর অপরাধ। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একসময় বিশ্বকাপ বা অলিম্পিকের মতো টুর্নামেন্ট ঘিরে মানবপাচারের ঘটনা ঘটতো। কিন্তু এখন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধদাসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জন্য শুধু দালালচক্র দায়ী তা কিন্তু নয়! যারা লোভের বশবর্তী হয়ে যাছাই বাছাই ছাড়াই দালালচক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছে তারও সমভাবে দায়ী।
আওয়ামী সরকারের শাসনামলে যত না উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এখন দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। দেশের সরকার যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণ কামনা করে তাহলে সামগ্রিকভাবে দেশে কল্যাণের সুবাতাস বিরাজ করে। সরকার চাইলেই মানুষের কল্যাণ করতে পারে। একসময় কাতারে মিউনিসিপালটিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসাবে থাইল্যান্ডের মানুষ কাজ করতো। আজকে কাতারে থাইল্যান্ডের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এখন তারা দেশে বসেই দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র। সরকার যায় সরকার আসে। কিন্তু মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী আমলে পরিবার ভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের কিছু পরিবারের সদস্যরা আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গিয়েছিল। এ প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে কিছু মানুষ শুধু অর্থবিত্তের মালিক হবে আর কিছু মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হবে। যারা বিদেশে যাচ্ছে তাদেরও সচেতনতার প্রয়োজন আছে। শুধু দালালের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
বাজারের এক কেজি আলু কিংবা তরকারি কিনলে সাত দোকান দেখে যাছাই করে কিনেন। অথচ যাছাই বাছাই ছাড়াই ভিনদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। পাশাপাশি রিক্রুট এজেন্সির ক্ষেত্রে তাদের অতীত রেকর্ড যাচাই করে দেখা উচিত। যেন বিপদে পড়তে না হয়। রাশিয়ার যুদ্ধদাসে যাদের জীবন বিপন্ন তাদেরই একজন রহমত আলী। এ রহমত আলীর স্ত্রী যমুনা খাতুনের ভাষ্যমতে জানা যায়, তার তিন বছরের মেয়ে নাদিয়া আফরিন শুধু বাবার কথা জিজ্ঞেস করে? কিন্তু আমি উত্তর দেবো কী? আমার বলার ভাষা নেই। আমার মেয়েটা তার বাবার সাথে কথা বলতে চায়! কান্নাকাটি করে। কিন্তু কী করে ওকে বলব তার বাবার সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। আমার একটাই দাবি দালাল চক্রের বিচার যেন হয়। ভুক্তভোগী মানুষগুলোর সাথে আমরাও সরকারের কাছে দাবি জানাই, অবিলম্বে দালাল চক্রের মূল হোতাদের ধরে বিচারের আওতায় আনা হোক। যেন আর কারও বাবা, ভাই হারিয়ে না যায় অজানা গন্তব্যে।