কলাম
দুর্নীতিতে আওয়ামী লীগের রেকর্ড
প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা।
Printed Edition
॥ এইচ এম আব্দুর রহিম ॥
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতির অবস্থা মূল্যায়নে গঠিত শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। যা গত বছরে দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশী। হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর পাচার হয়েছে, ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের দিয়ে ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। শে^তপত্র সংক্রান্ত কমিটির প্রধান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাত, বিদ্যুৎ-জ¦ালানি, উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে। ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিটির অতিরিক্ত ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশী। ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচিতে(এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশী ব্যয় হয়েছে। এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে। সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকখাতে। দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় খাত হচ্ছে অবকাঠামো প্রকল্প, তৃতীয় জ¦ালানি এবং চতুর্থ দুর্নীতি গ্রস্তখাত খাত হিসেবে তথ্য প্রযুক্তির (আইসিটি) নাম উল্লেখ করা হয়। আমলাদের পর দ্বিতীয় স্থানীয় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং তৃতীয় শীর্ষ র্দুনীতিগ্রস্ত হিসাবে ব্যবসায়ী গোষ্ঠির কথা উল্লেখ করা হয়।
এ সময় কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর ১০ শতাংশ অবৈধ লেনদেন ধরা হলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্ল্যাক হোলের গভীরে ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে সুপারিশ করেছে কমিটি। প্রবাসিরা ঘামঝরা কষ্টের আয় দেশে পাঠান ঠিকই কিন্তু সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে চুরি ও লুটপাট করে দেশের টাকায় বিদেশে বিলাসি জীবন যাপন করেন ঘুষখোর দুর্নীতিবান লুটেরা। চক্রটি ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দুবাই, কানাডা, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে বউ বাচ্চা নিয়ে বিলাশ বহুল ফ্ল্যাট কিনে আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে টি আই বিগত ৩রা ডিসেন্বর রির্পোটে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সেবা খাতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। ২০২৩ সালে ঘুষের হার বেশী । ভূমি, বিচারিক সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পার্সপোর্ট স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও বিআরটিতে। এ বছর প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা দেশের মানুষ সরকারি ও বেসরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছে। এরমধ্যে ভূমিতে ২ হাজার ৫১৩ কোটি, বিচারিক সেবায় ২ হাজার ৫১৩ কোটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থায় ২ হাজার ৩৫৭ কোটি ৫০ লাখ, পাসপোর্টে ১ হাজার ৩৫০ কোটি, স্থানীয় সরকারে ৮৪০ কোটি ৯০ লাখ, বিদ্যুতে ৩০৯ কোটি ৬০ লাখ, স্বাস্থ্য খাতে ২৩৫ কোটি ১০ লাখ ও শিক্ষায় ২১৩ কোটি ৯০ লাখ।
সুত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ আ্রব আমিরাতে দুবাই, আবুধাবিসহ বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশীদের এক লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এখানে বাংলাদেশীদের ৭০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে ৬০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এশিয়ার ট্যাক্স হেভেনে আর বাকীটা ইউরোপ আমেরিকায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নরসহ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১৭ লাখ কোটি টাকা। টাকা পাচার করা দেশ গুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইমান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশভার্জিন আইল্যান্ডের কথা বলা হয়েছে। দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের শত শত ফ্ল্যাট বাড়ী রয়েছে। দুবাইয়ে বিলাস বহুল অট্টালিকা বুর্জ খলিফা। টানা ৫ বছর ধরে ছয় হাজার ৮৩২ জন শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশে^র সর্বোচ্চ উচ্চতর এই ভবণ নির্মাণ করেন। আর এই শ্রমিকদের মধ্যে ৪ হাজার ছিলেন বাংলাদেশী। টানাটানির সংসারে এসব প্রবাসি শ্রমিকরা বাড়ীতে প্রিয়জন ফেলে রেখে তাদের ভাগ্য বদলের আশায় উত্তপ্ত মরুর দেশে গিয়ে রক্ত পানি করা খাটুনি দিয়ে বিশে^র অন্যতম বিলাস বহুল এই ভবন তৈরি করেন। তাদের ওই কষ্টের আয়ে তিল তিল করে জমানো টাকা রেমিট্যান্স হয়ে দেশে আসে। অথচ কষ্টার্জিত টাকাই নানা কৌশলে লুট করে নিয়ে গিয়ে ওই ভবনেই ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে আরাম আয়েশ আর ভোগ বিলাসে মত্ত আছে আরেক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ চক্র। সুত্র মতে, দেশের টাকা পাচার করে অপরাধ চক্রটি বুর্জ খলিফাতে কিনেছে ৭৭ টি ফ্ল্যাট। সুত্র মতে, ব্যাংকের টাকা লোপাট করে আমদানি রপ্তানির আড়ালে, কর ফাঁকি দিয়ে ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ৮৪৭ টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ী, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্পেস কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
দুর্নীতি সমাজের ভিত্তিকে ক্ষয় করে এবং ভিন্নমতকে নীরব করে দেয়। এটি কিছু মানুষকে সমৃদ্ধশালী এবং প্রতাপশালী করে তুললেও, দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা নেতাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ এবং ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়। দুর্নীতি দমনে প্রয়োজনীয় সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সবপক্ষ থেকে মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের তরুণেরা জাতির জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের বৈষম্য বিরোধী স্পিরিটকে দেশ সংস্কার এবং বিনির্মাণের কাজে লাগাতে হবে।