কলাম
স্মৃতিতে-স্মরণে মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদী
নড়াইলে ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন মরহুম ডা. মুহা. আবুল হোসাইন। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি নড়াইলে জামায়াতের কাজের সূচনা করেন এবং ১৯৭০ সনে প্রাদেশিক পরিষদে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন।
Printed Edition
![Sangram-Default Image](https://static.dailysangram.com/images/Sangram-Default_Image_hHflr46.original.jpg)
॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥
নড়াইলে ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন মরহুম ডা. মুহা. আবুল হোসাইন। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি নড়াইলে জামায়াতের কাজের সূচনা করেন এবং ১৯৭০ সনে প্রাদেশিক পরিষদে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন। সে সময়ে তাঁর সহযোগী ছিলেন মুন্সী আব্দুল জলিল (দলজিতপুর), অধ্যাপক আকবর হোসাইন (সীমাখালী), মৌলভী আব্দুল মান্নান মল্লিক (ভওয়াখালী), মুন্সী মোহাম্মদ হোসাইন (লোহাগড়া), মানসুর আহমদ (লোহাগড়া), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (লাহুড়িয়া), মৌলভী সিরাজুল ইসলাম (লাহুড়িয়া), অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান (কালিয়া) প্রমুখ। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে নড়াইলে জামায়াতের কোনো রুকন ছিল না। সে সময়ে ডা. মুহা. আবুল হোসাইন মহকুমার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতাত্তোর জামায়াতের কাজে গতি সঞ্চার হয় এবং ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ নড়াইল জেলা ঘোষিত হলে ডা. মুহা. আবুল হোসাইন প্রথম জেলা আমীর হন এবং মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদী জেলা সেক্রেটারি মনোনীত হন। অসুস্থতাজনিত কারণে ডা. মুহা. আবুল হোসাইন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলে ১৯৯৩ সনে মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদী জেলা আমীর নির্বাচিত হন এবং জেলা সেক্রেটারি মনোনীত হন আ ত ম ফিরোজ কবির। তাঁর সময়কালে আরো নেতৃবৃন্দ ছিলেন মাওলানা আশেক এলাহী, এনামুল হক বাচ্চু, আয়ুব হোসেন খান, মাস্টার নবী হোসাইন, মানসুর আহমদ (লোহাগড়া), অধ্যাপক এম এইচ বাহাউদ্দিন (কালিয়া), মো. আলমগীর হোসাইন প্রমুখ। সুদীর্ঘ একুশ বছর জেলা আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অসুস্থতাজনিত কারণে ১০ই জানুয়ারি ২০১৪ জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি নেন।
মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদী ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক ও বরেণ্য আলেম। শিক্ষকতার বাইরে পুরো সময়টা তিনি ইসলামী আন্দোলনে ব্যয় করেন। তাঁর সময়কালে জামায়াত, শিবির ও ছাত্রী সংস্থাসহ সকল অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলন প্রসার লাভ করে। ডা. মুহা. আবুল হোসাইন ইসলামী আন্দোলনের যে চারা গাছটি রোপণ করেছিলেন তা ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে শক্ত কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। নড়াইলে ইসলাম প্রচার বইতে দেখা যায় ২০০২ সনে নড়াইলে ৫৫ জন পুরুষ রুকন, ১৫ জন মহিলা রুকন ও সহস্রাধিক কর্মী ছিল এবং বর্তমানে নড়াইলে শুধু রুকনই রয়েছে সহস্রাধিক। বর্তমানে তরুণ নেতৃত্বে নড়াইলে কাজের যে গতি তা সারা দেশের মাঝে উল্লেখ করার মতো। এড. আতাউর রহমান বাচ্চু (জেলা আমীর) ও উবাইদুল্লাহ কাইসার (জেলা সেক্রেটারি) দু’জনই নড়াইলের জমিনে ছাত্রশিবির থেকে এসেছেন।
নড়াইলে অবস্থানকালে (১৯৯৬-২০২৪) মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মাওলানা জিহাদী সাহেবের নিকট থেকে আমি প্রভূত সহযোগিতা পেয়েছি। একজন সদাচারী ব্যক্তি হিসেবে তিনি পেয়েছেন দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নড়াইল আলেম-উলামাদের বাস। সেখানে আলিয়া ও কওমীর মাঝে কোনো বিরোধ নেই। এর পেছনে বড়ো অবদান রয়েছে শাহাবাদ মাজীদিয়া কামিল মাদ্রাসা (প্রতিষ্ঠা ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি) এবং নড়াইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। আমার পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রব (রহ.) ও মুফতি আশরাফ আলী (রহ.)। নড়াইলে আমার অবস্থানকালে অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রব (রহ.) ছিলেন মসজিদ মিশনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং মুফতি আশরাফ আলী (রহ.) ছিলেন সভাপতি। এই দু’জনের একজন আলিয়া ও অন্যজন কওমী অথচ পরস্পরের প্রতি কত শ্রদ্ধাবোধ! মাওলানা জিহাদী তাঁদের দু’জনকেই উস্তাদ হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন। ব্যক্তি হিসেবে মাওলানা জিহাদী ছিলেন একজন উদার ও সহনশীল ব্যক্তি এবং সর্বমহলে ছিল তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। মসজিদ মিশনের দায়িত্ব পালনের ফলে নড়াইলের সর্বশ্রেণির আলেম-উলামা, সরকারি কর্মকর্তা এবং সামাজিক ও রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। নড়াইলকে আমি দেখেছি দলমত নির্বিশেষে সকলের সহঅবস্থান ও শান্তিপূর্ণ জেলা হিসেবে। এসবের পেছনে একজন রাজনীতিক হিসেবে নূরুন্নবী জিহাদীর ইতিবাচক ভূমিকা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র স্বভাবের, বক্তৃতা করতেন ধীরস্থির ও শান্তভাবে এবং কারো প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। তাঁর চরিত্রই তাঁকে সর্বজনগ্রাহ্য করেছিল। আমার উপলব্ধি, আল্লাহপাকের কোনো বান্দা যদি শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারেন তাহলে সে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত প্রত্যাশা করতেই পারেন।
নড়াইলে অবস্থানের সময় বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের জেলা সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আন্তরিক সহযোগিতার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদীর প্রতি এবং আল্লাহপাকের কাছে তাঁর মাগফেরাত কামনা করছি। সর্বশ্রেণির মানুষের সহযোগিতা নিয়ে আমরা মসজিদ মিশনের উদ্যোগে নড়াইলে আল্লাহর দীনের পক্ষে বহু কাজ করেছি। ইমাম প্রশিক্ষণ, ইমাম সমাবেশ, সেমিনার, তাফসির মাহফিল ও নানাবিধ আলোচনা সভা। এসব প্রোগ্রামে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ স্বচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করতেন। নড়াইলে আমাদের তিনটি প্রকাশনা ছিল- ইসলামী সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা, নড়াইলে ইসলাম প্রচার-১ ও নড়াইলে ইসলাম প্রচার-২। আমাদের কর্মতৎপরতার ফলে মসজিদ মিশন নড়াইল জেলা শাখা দেশের প্রথম হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল।
দীর্ঘ আটটি বছর আমি নড়াইলে অবস্থান করেছিলাম কিন্তু কখনো জিহাদী ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে একটি সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করার জন্য নড়াইল গিয়েছিলাম। সেসময়ে জিহাদী ভাইকে দেখার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে যাই। ২১ বছরের জেলা আমীর অথচ নড়াইল শহরে তাঁর কোনো বাড়ি নেই এবং গ্রামে যে বাড়িটা তা জরাজীর্ণ, কোনো বাউন্ডারি ওয়াল নেই। অথচ আমাদের দেশে রাজনীতিকে বাড়ি-গাড়ি ও সম্পদশালী হওয়ার উপযুক্ত উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং অনেকেই অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হন।
বরেণ্য আলেম ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ মাওলানা নূরুন্নবী জিহাদী গত ২৬শে জানুয়ারি বিকেল চারটায় ৭৮ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল¬াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, সাত মেয়ে ও এক ছেলে এবং অগণিত নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষী রেখে তাঁর মহান রবের কাছে ফিরে গেলেন। পরের দিন ২৭শে জানুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় তাঁর জানাযায় মানুষের ঢল এবং জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার জানাযায় ইমামতি করেন। দোয়া করি, আল¬াহ তায়ালা যেন তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করেন এবং পরিবারকে তাঁর রহমতের চাদরে আবৃত করে রাখেন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।