কলাম
কালের অভিভাবক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সকাল দশটায় দেশ ও দশের অন্যতম অভিভাবক সাবেক বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের পথে রওয়ানা দিয়েছেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি বারবার অসুস্থ হচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন।
Printed Edition
॥ মাহবুবুল হক ॥
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সকাল দশটায় দেশ ও দশের অন্যতম অভিভাবক সাবেক বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের পথে রওয়ানা দিয়েছেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি বারবার অসুস্থ হচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন।
তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি ধর্ম, বর্ণ. মতবাদ আদর্শ নির্বিশেষ সবার ডাকে তিনি সাড়া দিতেন। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। মাত্র তখন গণঅভ্যুত্থান শেষ। থমথমে ভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেক শাহাদাত বরণ করলেন। যেখানে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গভীর রাত্রে একটা মসজিদ তৈরি হলো। ভোর হওয়ার আগেই সেই মসজিদ আবার আমাদের চোখের সামনে ভেঙে ফেলা হলো।
আমরা তখন (১৯৬৯) ‘মুক্তবুদ্ধি সাহিত্য সংঘ’ নামে আমাদের গড়া একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছি। এ প্রতিষ্ঠানের কোনো অফিস ছিল না। আমরা যখন যেখানে অবস্থান করি সেটাই ছিল আমাদের অফিস। আমরা দুই বন্ধু, আমি ও সানাউল্লাহ আখুঞ্জী আব্দুর রউফ স্যারের পাশে বাসা নেওয়ার পূর্বে অন্য দু’টি জায়গায় থাকতাম। প্রথমটি হলো, তোপখানা রোডের ‘ন্যাশনাল রেস্ট হাউস’। চারতলা এ খোলামেলা ভবনটির নাম পরবর্তীতে হয় ‘হোটেল সম্রাট’।
স্যারের সঙ্গে দেখা হতো মাঝে মাঝে। যখন তার টুপি-রুমাল-মোজা বন্ধুবর বানরগুলো নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। আমাদের সাথে বেশ জমে ওঠেছিল এক ঝাঁক ছোট-বড় বানরের। বেশ প্রাচীন কাঁঠাল গাছটায় ওদের বড় বাসা ছিল। বাড়ির মমতাময়ী খালাম্মা ওদের খাওয়ার দিতেন। আমরা মাঝে মাঝে পাউরুটি দিয়ে খাতির রাখতাম। স্যার বাসা থেকে মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলতেন- বানরের সাথে আপনাদের’তো অনেক খাতির, দেখেন তো অনুরোধ করে, আমার টুপিটা দেয় কিনা। তাকিয়ে দেখতাম কাঁঠাল গাছের শেষ মাথায় টুপি-রুমাল-মোজা নিয়ে ওরা বেশ খেলাধুলা করছে। আনন্দে মাতামাতি করছে। আমরা পাউরুটিসহ কিছু খাবার-দাবার দিয়ে ওদেরকে বশে আনতাম।
বনগ্রামবাসী আল্লামা আবুল হাশেমের ধীমান ও বরেণ্য রাজনৈতিক সেক্রেটারি, পূর্ব বাংলার ওষুধ শিল্পের জনপ্রিয় পৃষ্ঠপোষক, স্বনামধন্য লেখক এস. মজিবুল্লাহ, যাঁর একটি ‘হট কেক’ রসঘন বই “ওলট পালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই” ৭০দশকে দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল, যিনি মাঝে মাঝে বানরের ব্যবসাও করতেন। তিনি এ পাশটায় এলে আমরা বলতাম, না ভাই, এখানে এখন বানর নেই। আমাদের মত কিছু অমানুষ আছে। সম্ভব হলে আমাদেরকে রপ্তানি করেন। সুগন্ধেভরা পান খাওয়া রক্তিম মুখে অপরূপভাবে হাসতেন। হায়! কোথায় এখন সেই অভয়ারণ্য!
যতদূর মনে পড়ে স্যারের সাথে আলাপে আলাপে জেনেছিলাম, ছাত্র জীবনে তিনি ছাত্রলীগ করতেন। কিছুদিন ছাত্র ইউনিয়নের সাথেও যুক্ত ছিলেন। সে কারণে আমাদের ধারণা ছিল, তিনি হয়তো নিজ জেলা ময়মনসিংহে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকদিন স্যারের সাথে দেখা হয়নি। সত্য কথা বলতে স্যারকে আমরা সেভাবে খুঁজিও নি। অকৃতজ্ঞতার সিলসিলা তো আমাদের মধ্যেও আছে। অথচ আমরা কেবল নিজেরটা বাদ দিয়ে অপরের অকৃতজ্ঞতা পরিমাপ করতে থাকি।
হঠাৎ একদিন এম. এ. হান্নান ভাই বললেন, বড়ভাই এডভোকেট গাফফার ভাইয়ের চেম্বারে আব্দুর রউফ স্যারের সাথে দেখা হয়েছে। আমাদের সবার কথা তিনি জিজ্ঞেস করেছেন। হান্নান ভাই আরো বললেন, ‘স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদের’ পরবর্তী প্রোগ্রামে তিনি মেহমান হিসেবে আসবেন। প্রোগ্রামটা ইসলামী একাডেমী বা শিল্পকলা একাডেমী, কোন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না।
সেই তাঁর সাথে শুরু হলো পুনঃযোগাযোগ। এ সময়টায় তিনি নিজস্ব ‘আইন পেশা’য় দারুণভাবে মগ্ন, সংযুক্ত ও থিতু হয়েছেন। তবুও আমাদের আহ্বানে মাঝে মাঝে তিনি সাড়া দিতেন। সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে, গুছিয়ে-গাছিয়ে খুব সুন্দরভাবে কথা বলতেন। কথা বলতে বলতেই আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। গন্তব্য ঘুরে যাচ্ছে এবং লক্ষ্যও ঘুরে যাচ্ছে।
সুফিজম থেকে শুরু করে, তাঁর সত্যের অন্বেষা দ্রুততার সাথে বেগ পেতে থাকলো। সত্যের অন্বেষা ও পেশায় তিনি দারুণভাবে স্থিত হয়ে গেলেন। আইন পেশায় যে মগ্নতা তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা তাঁকে সমাজের উঁচুতলায় স্থান করে দিয়েছিল। বিচারপতি হওয়ার পর তাঁর মধ্যে আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন দেখিনি। চৌকস রাজনীতিবিদ মশিউর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ আমাকে খেতে পারবে না, আমি প্রয়োজনে মার্সিডিজ বেঞ্জ খাব।’
আমাদের ছোটকালে দেখেছি, বিচারপতি দূরে থাক, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরাই এক ধরনের অসামাজিক, পরাধীন বা বন্দী জীবন যাপন করতেন। আমাদের পাশের বাসায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকতেন। ওই পরিবারটি সমাজ-বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো। ভদ্রলোক, আব্বাজানের বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তাঁদের যোগাযোগ হতো কোর্টে। আমরা ‘নেক্সট ডোর নেইবার’ ছিলাম। কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে কোনো যাওয়া-আসা ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বড়ছেলে ছিলো, আমার নিকটতম বন্ধু। আমরা একই কলেজে পড়তাম। কিন্তু আমাদের একসাথে যাওয়া-আসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কলেজে এবং পাড়ার মসজিদে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো।
আমাদের স্যার, তেমনটি ছিলেন না। ওকালতি করার সময় যে স্বাধীন জীবন তিনি উপভোগ করেছিলেন অর্থাৎ যে জীবনাচরণে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন, সেটার ওপরেই তিনি থিতু ছিলেন। প্রচুর সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাসায় তিনি বেড়াতে যেতেন। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হতেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সমানভাবে দেখতেন। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতেন না।
বিচারপতি থাকাকালেই তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন, একটা সুষ্ঠু, সুন্দর, ন্যায়ানুগ ও সুবিচারপূর্ণ নির্বাচনের। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান গবেষণা করে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বড় দুই রাজনৈতিক দলের অন্যায় হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর সে স্বপ্ন, ভন্ডুল হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। এ বিষয়টা নিয়ে তখন অনেকেই সমালোচনা করতেন যে সৎ, যোগ্য ও ক্যাপাবল হওয়া সত্বেও তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
অবসর গ্রহণের পরে, আজ থেকে প্রায় ২১/২২ বছর আগে তিনি, জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠান ‘কেন্দ্রীয় ফুলকুঁড়ি আসর’-এর উপদেষ্টা পরিষদের ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সম্পাদক সানাউল্লাহ নূরীর ইন্তিকালের পর ‘ফুলকুঁড়ি আসর’ এমন একজন ‘প্রধান উপদেষ্টা’কে আন্তরিকভাবে খুঁজছিলো। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিলো বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের। যিনি ছিলেন তখন জাতীয় পর্যায়ের একজন অন্যতম অভিভাবক। সে থেকে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় ফুলকুঁড়ি আসরের ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে বয়স্ক যুবকের মত কাজ করেছেন। তিনি ‘ফুলকুঁড়ি আসর’-এর শিশু-কিশোরদেরকে ‘ভাইয়া’ বলতেন। তারাও তাঁকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতেন। আসলে তিনি ছিলেন, ফুলকুঁড়িদের দাদা ও নানার মতো। উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্য যখন ফুলকুঁড়িদের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতো, তখন তিনি দারুণভাবে বিব্রতবোধ করতেন। তখন তিনি বলতেন, ‘আপনারা উপদেষ্টা হিসেবে যাঁরা এখানে আছেন, তাঁরা সবাই বয়স্ক। কিন্তু আমি’তো আপনাদের সে স্টেজ পার করে এসেছি। সবাই আপনারা এমপ্লয়ার, আপনাদের অধীনে অনেকে চাকরি করে। সেজন্য আপনারা মানুষের দোষ-ত্রুটি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আমি তো এখন আর আগের মতো এমপ্লয়ার নই। আবার এমপ্লয়িও নই। তাই আমার সাথে আমার ‘ভাইয়া’-দের খুব মিল আছে। তারাও আমার মতো। এমপ্লয়ার নয় আবার এমপ্লয়িও নয়। তারা চাকরি করে না এবং চাকুরেও নয়। আপনারা একটু আলাদা। আসুন আমরা ওদের দোষ-ত্রুটি না ধরি। ওরা এখানে স্বেচ্ছাসেবক। ওরা সবাই ভালো ছাত্র। ওদের অনেক পড়াশুনা করতে হয়। লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হয়। খেলাধূলা করতে হয়। ব্যায়াম করতে হয়। মাঝে মাঝে পরীক্ষা দিতে হয়। এর ভেতরেও আসরের অনেক কঠিন-কঠিন কাজের সাথে তারা জড়িত। কোথায় ওদের সময়। ওদের পিতামাতা ও অভিভাবকগণ চান উচ্চশিক্ষা শেষ করেই ওরা ভালো চাকরিতে ঢুকে পড়বে।
‘কেন্দ্রীয় ফুলকুঁড়ি আসর’কে তিনি নিজের নাতি-নাতনিদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তাদেরকে তিনি জীবনে যত সময় দিয়েছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় দিয়েছেন ‘ফুলকুঁড়ি আসর’কে। আর্থিক ও নৈতিক দিক থেকে তিনি ‘ফুলকুঁড়ি’কে সাজিয়েছেন। রূপান্তর করেছেন জাগতিকভাবেও। এখনতো দেশে ‘ফুলকুঁড়ি’ ছাড়া আর কোনো উন্নত ‘শিশু-কিশোর সংগঠন’-এর অস্তিত্ব নেই। ‘ফুলকুঁড়ি’ দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে, প্রাণবন্ত হচ্ছে, সজীব হচ্ছে-এর বড় কারিগর ছিলেন, বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ। আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা, যতদিন ‘ফুলকুঁড়ি’ও এদেশের নৈতিক মানুষ বেঁচে থাকবে, ততদিন ‘তিনি’ও ইনশাআল্লাহ বেঁচে থাকবেন এদেশের আপামর নৈতিক জনতার কাছে।