DailySangram-Logo

কলাম

কেন এত অবহেলা

চরম অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে জীবনের সুন্দর বসন্তগুলি পার করেও যখন বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যান তখন সে কষ্টের আগুন যেন আরো বহু মাত্রায় বেড়ে যায়। তাদের অবসর আর কল্যাণের টাকা পেতে গলদঘর্ম হতে হয়।

Printed Edition

॥ মাজহার মান্নান ॥

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা কতটুকু মহান সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের এমন দিন খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে যেদিন শিক্ষকরা দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সরস্কারের আওয়াজ জোরালো হলে বেসরকারি শিক্ষকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু সেটাতেও যে গুড়েবালি। চরম অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে জীবনের সুন্দর বসন্তগুলি পার করেও যখন বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যান তখন সে কষ্টের আগুন যেন আরো বহু মাত্রায় বেড়ে যায়। তাদের অবসর আর কল্যাণের টাকা পেতে গলদঘর্ম হতে হয়। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ২০০৫ সাল থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের অবসর সুবিধা চালু করা হয়। শিক্ষক কর্মচারীরা দুটি সুবিধা পেয়ে থাকেন। একটি হল সর্বশেষ বেসিকের ৭৫ মাসের টাকা (যদি চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়) যেটি পেনশন নামে পরিচিত। অন্যটি হল কল্যাণ তহবিলের টাকা। তবে শিক্ষকরা এ সুবিধা বিনা শর্তে পান না। তাদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ হারে প্রতি মাসে বেতন থেকে কেটে রাখা হয়।

৬ শতাংশ অবসর ভাতার জন্য এবং ৪ শতাংশ কল্যাণ তহবিলের জন্য। পূর্বে ৬ শতাংশ কাটা হত। পরবর্তীতে ৪ শতাংশ যুক্ত করা হয়। শিক্ষক কর্মচারীদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হবার পর এ ৪ শতাংশ কর্তন শুরু হয়। এ কর্তন নিয়েও শিক্ষকদের মাঝে অস্বস্তি রয়েছে। যাহোক শিক্ষক কর্মচারীরা ১০ শতাংশ হারে দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অবসরে গিয়ে তাদের সেই গচ্ছিত টাকা ফেরত পেতে বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। পদে পদে হেনস্তা হতে হয় তাদের। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে আগের থেকে এখন হয়রানি অনেকটা কমেছে। তারপরও অবসর ভাতা পেতে তাদের বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। সরকার কয়েক ধাপে ঘাটতি পূরণে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। তারপরও সবার পাওনা পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে। এখনো ঝুলে আছে লক্ষাধিক ফাইল। শিক্ষকদের অবসর সুবিধার গিঁট ছাড়ানোর জন্য যেন কেউ নেই। শিক্ষক কর্মচারীদের হাহাকার যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় না।

আন্দোলন সংগ্রাম করতে করতেই শিক্ষকদের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়ে যায়। অভাব অনটনের সংসারে শুধু স্বপ্ন বুননই চলতে থাকে। কিন্তু সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখা যায় না। এখনো ৪/৫ বছর লাগে অবসরের টাকা হাতে পেতে। ৬০ বছর পর এমনিতেই বার্ধক্য ভর করে শরীরে, তার উপরে অবসর ভাতা প্রাপ্তির জ্বালা যেন জীবনকে দগ্ধ করতে থাকে। শিক্ষক কর্মচারীদের এ সমস্যা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। সরকারি চাকরিজীবীরা যদি তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবসরের টাকা পেয়ে থাকেন তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা কেন পাবেন না? সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তথ্য উপাত্ত এখন আপডেট আছে। তাই অবসরে যাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করলে খুব একটা বেশি সময় লাগার কথা নয়। বর্তমানে আবেদনের সাথে ব্যাংক একাউন্ট নম্বর চাওয়া হয় এবং সেখানে টাকা জমা হয়। এটা খুব ভাল একটি দিক। অবসরের টাকা পেতে শিক্ষক কর্মচারীরা ম্যানেজিং কমিটির দ্বারাও হেনস্তার শিকার হোন এমন খবর বহুবার পত্রিকায় এসেছে। সেটা থেকে আপাতত পরিত্রাণ মিলেছে। তবে শিক্ষকদের আদালতের দ্বারস্থ হয়ে তাদের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য লড়তে হচ্ছে। আদালত যে রায়টি দিয়েছে সেটি একটি যুগান্তকারী রায়। ৫ লাখ শিক্ষক কর্মচারীর অবসর সুবিধা ৬ মাসের মধ্যে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। আদালতের এ নির্দেশনার পর বঞ্চিত শিক্ষকদের মুখে হাসি ফুটবে। কেননা অবসর সুবিধা প্রাপ্তির জটিলতার মারপ্যাঁচে শিক্ষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। প্রায়ই একটি কথা শোনা যায়। তহবিল সংকটের কারণে সবাইকে সময়মত অবসর সুবিধা দেয়া সম্ভব হয় না। এ যুক্তি কতটা খাটে? সরকারি চাকরিজীবীদের বেলায় এমন কথাতো শোনা যায় না। আমরা পদ্মা সেতু বানাতে পারি, বঙ্গবন্ধু টানেল করতে পারি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে পারি, অথচ শিক্ষকদের পাওনাটুকু সময়মত বুঝিয়ে দিতে যত ঝামেলা। এক্ষেত্রে কেন অপারগতা?

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দিনটি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই অবিস্মরণীয়। উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে অবসরের ৬ মাসের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পাওনা দিয়ে দিতে। অবসরের টাকা উত্তোলনে যে বিড়ম্বনা চলছিলো সেটা থেকে শিক্ষকরা পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু কী হল সেটার? বেসরকারি শিক্ষকদের এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই। তদুপরি, অবসরের টাকা পেতে ঘাম ঝরে যেত শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক আছেন যারা মারা গেছেন অথচ জীবদ্দশায় অবসরের টাকার মুখ দেখতে পারেন নি। বয়সের ভারে জীবন যখন এমনিতেই চলতে চায় না, তখন অবসরের টাকা পেতে হিমালয়সম প্যারা জীবনকেই যেন অর্থহীন করে তোলে। বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের প্রাপ্তি খুবই কম। অবসরে গিয়ে এককালীন কিছু টাকার মুখ দেখতে পান তারা। কিন্তু সেটা পেতে যখন চটি ক্ষয় হয়ে যায় এবং ঘুস দিয়ে টাকা পেতে হয় তখন সেটা আনন্দময় না হয়ে বিষময় হয়।

সম্প্রতি পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, অর্থ সংকট তীব্র হওয়ায় অবসর ও কল্যাণের টাকার নিষ্পত্তি আরও জটিল থেকে জটিল হচ্ছে। গত ৬ মাস ধরে অবসর ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ড বলতে গেলে অকার্যকর। কিন্তু কেন? এ সরকারতো শিক্ষাবান্ধব। কেন তবে অবহেলায় থাকবে এই সুবিধাগুলি? প্রায় ৭৪ হাজার আবেদন এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। ৫ লাখের বেশি শিক্ষক কর্মচারী আছেন। প্রতিবছর তাদের একটি অংশ অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু অবসর সুবিধা পেতে কেন এত জটিলতা? দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবসর ও কল্যাণের টাকা দেয়া হয়। তাদের কাছে প্রশ্ন করলে একই উত্তর টাকা নেই। এ রকম জবাবতো সরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নেই। কিন্তু কেন? সব অবহেলা কি তবে বেসিকদের ক্ষেত্রে? ৩৮ হাজার অবসর আর ৩৬ হাজার কল্যাণের ফাইল এখনো অনিষ্পন্ন। কবে হবে এর নিষ্পত্তি? খবরে প্রচার শিক্ষকদের গচ্ছিত টাকা গায়েব। এটা তদন্ত হওয়া উচিত। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং মাদরাসার ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ১০ শতাংশ কর্তনের পরও সরকার থোক বরাদ্দ দেয়। তাতেও নাকি সমাধান হচ্ছে না। জরিপ মতে ১০ শতাংশ কর্তনে মাসে ৭০ কোটি আসে। আর এফডিআর থেকে আসে ৩ কোটি। সব মিলিয়ে মাসে আসে ৭৩ কোটি। বছরে আসে ৮৭৬ কোটি। কিন্তু অবসরে প্রতিমাসে প্রয়োজন প্রতিমাসে ১১৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ৪২ কোটি প্রতি মাসে ঘাটতি। বছরে ৫০৪ কোটি ঘাটতি। সমস্যার সমাধান করতে দরকার ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কোথা থেকে আসবে এই টাকা? তবে কি বেসিকদের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে? কল্যাণের টাকা নিষ্পত্তি করতে দরকার ৩ হাজার ২শ’ কোটি। অবসরের পর সকল চাকরিজীবী ৬ মাসে সব পাওনা বুঝে পায়। কিন্তু বেসিকদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। এভাবেতো চলতে পারে না। সরকারকে এর সমাধানে নজর দিতে হবে।

আদালতের নির্দেশনার পর বেসরকারি শিক্ষকরা হালে পানি পাবেন। যেসব শিক্ষকদের পাওনা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে সেগুলি দ্রুত পরিশোধ করা হোক। যারা নতুন করে আবেদন করবেন অবসরের সুবিধার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে দেয়া হোক যেদিন তিনি/তারা টাকা হাতে পাবেন। আবেদন সম্পন্ন হওয়ার পর তাদের মেসেজ দিয়ে টাকা প্রাপ্তির ডেট জানানোর ব্যবস্থা করা হোক। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। আর যেটা না হলেই নয়, সেটা হল অবসর সুবিধা পেতে যে দুর্নীতি হয় সেটার কবর রচনা করা।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট