DailySangram-Logo

কলাম

প্রহসনের নির্বাচনে জড়িতদের বিচার করতে হবে

একই সাথে চারজন নির্বাচন কমিশনারও শপথ নিয়েছেন। তারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জনাব মো: আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব আবদুর রহমান মাসুদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব বেগম তাহমিদা আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জনাব আবুল ফজল মো: সানাউললাহ।

Printed Edition

॥ জালাল উদ্দিন ওমর ॥

অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সচিব জনাব এএমএম নাসির উদ্দিন গত ২৪ নভেম্বর দেশের চৌদ্দতম চীফ ইলেকশান কমিশনার (সিইসি) হিসাবে শপথ গ্রহন করেছেন। একই সাথে চারজন নির্বাচন কমিশনারও শপথ নিয়েছেন। তারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জনাব মো: আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব আবদুর রহমান মাসুদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব বেগম তাহমিদা আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জনাব আবুল ফজল মো: সানাউললাহ।

ভোটাধিকার একজন মানুষের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার হলেও, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এবং সংসদ নির্বাচনসহ কোন নির্বাচনেই জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এসব নির্বাচনে ভোটের নামে স্রেফ একটি তামাশা এবং ভন্ডামি করা হয়েছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় এসব ভোটের প্রতি জনগণের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। ফলে অধিকাংশ ভোটারই ভোট প্রদান করতে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। তাছাড়া এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে, জাল ভোট মেরে ব্যালেট বাক্স ভর্তি করেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে এবং নিজেদের ইচ্ছামত ফলাফল ঘোষণা করে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। সরকারের প্রশাসন এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই এসব কাজে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ফলাফলকে অনুমোদন করেছে এবং এর মাধ্যমে তারা এসব নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। আওয়ামী শাসনামলে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা এবং আগ্রহ এতটাই কমে যায় যে, স্বয়ং আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও তাদের দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটকেন্দ্রে যায়নি এবং ভোট দেয়নি। এখন নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনকে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে এদেশে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হয় দশম সংসদ নির্বাচন। তৎকালীন সিইসি ছিল কাজী রাকীব উদ্দিন আহমদ। বিএনপি-জামাত জোট সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সেবার ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোট করতে হয়নি। বাকী আসনগুলোতে নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হয়। বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সিইসি ছিল কে এম নুরুল হুদা। সে নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট অংশগ্রহণ করে। সেবারের ভোট ভোটের আগের দিন রাত্রে স¤পন্ন করা হয়। সরকারদলীয় কর্মীবাহিনী প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বানের আগের রাতে বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করে। এ ভোট ইতিহাসে নিশি রাতের ভোট হিসাবে পরিচয় লাভ করে। নিশি রাতের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশন যথারীতি নিশি রাতের এ ভোটকে অনুমোদন দেয়। পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সিইসি ছিল জনাব কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট অংশগ্রহণ করেনি এবং নির্বাচন বয়কট করে। আওয়ামী লীগ এবার নতুন ফর্মুলা প্রণয়ন করে। আওয়ামী লীগের বিরাট সংখ্যক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিল আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী। ডামি-আমির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করে। কিন্তু ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং পরবর্তীতে এই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। তিনটি সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রতিবারই তারা সংসদে বিরোধী দল হয়েছে।

আওয়ামী শাসনামলে অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনই ইতিহাসে প্রহসনের নির্বাচন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এ রকম কলংকের নির্বাচন পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেনি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ অন্যান্য যেসব নির্বাচন হয়েছে, সবই ছিল প্রহসনের নির্বাচন। এসব নির্বাচনের কোনটাতেই জনগণ স্বত:স্ফূর্তভাবে ভোট দেয়নি অর্থাৎ জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এসব নির্বাচনে ভোটের নামে ভোট কারচুপি হয়েছে। জনগণের ভোট প্রয়োগের হার ছিল একেবারেই কম। এসব নির্বাচন আওয়ামী লীগের ইতিহাসকে কলংকিত করেছে, একই সাথে সিইসি সহ পুরো নির্বাচন কমিশনকেও কলংকিত করেছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন নিশি রাতের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ডামি নির্বাচন হিসাবে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেছে। এককথায় আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে শুধু ভোট চুরিই করেনি, বরং পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করেছে। তারা নির্বাচনকে ছিনতাই করেছে। তারা পুরো বিশ্বে বাংলাদেশের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করেছে এবং বাংলাদেশীদের মান-সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসব প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। তারা মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে এবং জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। বিনিময়ে এসব কর্মকর্তারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। সুতরাং জনগণের ভোটাধিকার হরণ, প্রহসনের নির্বাচন, গণতন্ত্র হত্যা এবং স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিতেই হবে।

বিগত তিনটি নির্বাচনে সিইসি এবং ইসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারীদের এখনই বিচারের আওতায় আনতে হবে। শপথ এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করে তারা রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন। তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন এবং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। পুলিশ এবং প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতা করেছেন তারাও এর জন্য সমানভাবে দায়ী। এরা কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি বরং সব সময় আওয়ামী লীগের অন্যায় কাজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এরা সবাই স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদের দোসর, সহযোগী এবং সুবিধাভোগী। তাই এদের সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, বিচারের মুখোমুখি করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রহসনের নির্বাচনের সহযোগীদের বিচার এবং শাস্তি অপরিহার্য। এ ধরনের প্রহসনের নির্বাচন চিরতরে বন্ধ করতে হবে। সকল নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাই। পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে পুলিশ এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রতি ও উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।