কলাম
প্রাসঙ্গিক ভাবনা
দেশ রসাতলে যাচ্ছে একে উদ্ধার করুন
আমাদের এলাকায় প্রায় দুশ’ বছরের পুরাতন দীঘি আছে। আমাদের পাশের গ্রামেরই একজন হিন্দু ভদ্রলোক জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন। যা কাশি মজুমদারের দীঘি নামে পরিচিত। দীঘিটির জলাশয়ের পরিমাণ ১৬ কানি, স্থানীয় মাপে যা ১৯২০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯ একর ২০ শতক। দীঘির পাড়ের পরিমাণও হবে অন্যূন দশ একর।
Printed Edition
॥ ড. মো. নূরুল আমিন ॥
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সাথে ঢাকার উত্তরাস্থ এইড ফর হিউম্যানিটিজ নামক একটি বেসরকারি মানবিক সংস্থার কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, বাদশাহ ফয়সল ইনস্টিটিউটের একজন সাবেক অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অনুগ্রহ করে আমার গ্রামের বাড়িতে আমার পরিত্যক্ত ভাঙাঘর দেখতে গিয়েছিলেন। তালাবদ্ধ ঘর, দেয়ালের ইটগুলো বিবর্ণ, কাঠের জানালাগুলো কোথাও কোথাও কব্জা থেকে আলাদা হয়ে খসে পড়ে গেছে। ওখানে আমার জন্ম ও বড় হয়ে উঠা, এখন আমরা কেউ থাকি না। আম্মা ও বাবার কবর বাড়ির সামনে পারিবারিক কবরস্থানে। মূলত কবর জিয়ারতের জন্যই বাড়িতে যাওয়া। আরেকটা মূল উদ্দেশ্যও ছিল, সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংকটকালীন প্রায় এক দশকের আমীর ও কা-ারী মরহুম মকবুল আহমদের একটি অসিয়তের বাস্তবায়নাবস্থা প্রত্যক্ষ করা ও অছিয়ত অনুযায়ী তার মায়ের মালিকানাধীন ৯৩ শতক জমির (যা পারিবারিকভাবে দান করে দেয়া হয়েছিল) উপর একটি এতিমখানা, মহিলা মাদরাসা ও দুস্থ বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দরিদ্র মহিলাদের জন্য একটি বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অবস্থা ও সম্ভাব্যতা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা। জমিটি মূল সড়কের পার্শ্বে একটি উৎকৃষ্ট স্থানে অবস্থিত (Prime location) যার বর্তমান মূল্য হবে অন্যূন পাঁচ কোটি টাকা। জমিটি রাস্তার লেভেলের অনেক নীচে এবং ভরাট করে উঁচু করা ছাড়া নির্মাণ কাজ শুরু কঠিন। সে ক্ষেত্রে পিলারের উপর ভবন তৈরি করতে হবে। মরহুম মকবুল আহমদ জীবিত থাকাকালেই তার সাথে আমার প্রস্তাবিত জমির ব্যবহার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাস, কারিকুলাম, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা অভিজ্ঞতাসহ মাটি ভরাট নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল।
আমাদের এলাকায় প্রায় দুশ’ বছরের পুরাতন দীঘি আছে। আমাদের পাশের গ্রামেরই একজন হিন্দু ভদ্রলোক জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন। যা কাশি মজুমদারের দীঘি নামে পরিচিত। দীঘিটির জলাশয়ের পরিমাণ ১৬ কানি, স্থানীয় মাপে যা ১৯২০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯ একর ২০ শতক। দীঘির পাড়ের পরিমাণও হবে অন্যূন দশ একর।
দীঘির দক্ষিণ পাড়ে পূর্ব চন্দ্রপুর প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন অংশে আমাদের এলাকার অনেক মুসলিম পরিবারেরই পূর্ব পুরুষদের কবর রয়েছে। যখন দেশে টিউবওয়েল ছিল না, তখন এলাকাবাসী এ দীঘি থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। পানি কমে গেলে এ দীঘির মাছ ধরারও একটা উৎসব হতো। কয়েক গ্রামের মানুষ পলো, কোচ এবং জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কাশি মজুমদার পরিবার দেশ ছেড়ে হিন্দুস্তান চলে যান এবং দীঘিটি পরবর্তীকালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে খাস খতিয়ানে চলে যায় এবং আমাদেরই গ্রামের দুটি পরিবার ইজারামূলে দীঘি ও তার পাড়ের মালিক বনে যান। তাদের মধ্যে মালিকানা নিয়ে এখনো মামলা চলছে। বলাবাহুল্য এর মধ্যে দীঘির রক্ষণাবেক্ষণেও বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। দীঘির বেশিরভাগই কচুরিপানার দখলে চলে যায় এবং পচা কচুরিপানা গভীর স্তর সৃষ্টি দা’মের সৃষ্টি করে যার উপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যেতে পারে। দীঘিটি সংস্কার করে মাছ চাষ ও ব্যবহার উপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় খনন কাজ কখনো করা হয়নি। এমতাবস্থায় দু’বছর আগে আমারই এক ভাই অপ্রয়োজনীয় একটি পুকুর ভরাট করার জন্য পাইপ দিয়ে দীঘি থেকে মাটি আনার উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগে গ্রামের এক ব্যক্তি বাধা দেন। তিনি ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং পার তা ৪০০০০/- টাকায় রফা হয়। আমরাও মকবুল আহমদ সাহেবদের দান করা জমিটি ভরাটের জন্য একইভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতা নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও উপরোক্ত ব্যক্তি তিন লাখ টাকা দাবি করে এবং তিনবার সংশ্লিষ্ট ভরাটকারী ঠিকাদারদের পাইপ ও মেশিন তুলে নিতে বাধ্য করে। এলাকাবাসীর তথ্যানুযায়ী তার সাথে স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী যোগ দেয় এবং বর্ণিত জমিতে জামায়াতের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার অজুহাত দেখিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার ভূমি এর দফতরে অভিযোগ দায়ের করে। ফলে যে মাটি ভরাটের কাজ প্রায় দেড় বছর আগে শেষ হবার কথা ছিল তা আজো শেষ হয়নি, তবে আশার কথা যে, কাজটি শুরু হয়েছে এবং এজন্য বাধ্য হয়ে চাঁদাবাজদের চাঁদাও দেয়া হয়েছে।
একটা কবিতার কয়েকটি ছত্র এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। কবির নাম আমার মনে নেই, ছত্রগুলো হচ্ছেÑ
“শুনেছ মসাই
মরেছে কসাই
মানুষ হয়েছে হায়েনা
আহা বেচারা, বেচতে এসেছিলো
অন্ধের কাছে আয়না।”
এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এ ছত্রগুলো বার বার মনে পড়েছে। শেখ মুজিব ও তার কন্যা শেখ হাসিনা তাদের দুঃশাসন ও ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে আমাদের এ মুসলিম বাংলার আবহমান মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে এমনভাবে ধ্বংস করেছেন যে, তাকে চেনাই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। গ্রামের বাড়িতে আমি বিকেল তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত ছিলাম। এ সময়ের মধ্যে দুটি মারাত্মক খবর শুনে আমি আহত হয়েছি। একটি হচ্ছে দাগনভূঞা উপজেলা হেড কোয়ার্টারে চাঁদাবাজি নিয়ে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের ভয়াবহ আন্তঃকোন্দল, আরেকটি হচ্ছে এ উপজেলারই অন্যতম বাজার আমু ভূইয়ার হাটে তাদেরই দলীয় মারামারি ও চাঁদাবাজি এবং দখলবাজি। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এখন মাঠে নেই, তাদের স্থান দখল করেছে এখন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো। এটা আমার কথা নয়, গ্রামের নির্দলীয় নিরীহ মানুষদের কথা। এদের আবার উসকানি দিচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতা, যারা প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে বলে বেড়াচ্ছেন যে, ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের ছেলেরা গত ১৭ বছর ধরে কিছু খেতে পারেনি, উপোস রয়েছে। এখন যদি তারা কিছু খায় বা খেতে চেষ্টা করে আপত্তি কেন? আপত্তি হচ্ছে এ জন্য যে, এটা তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি নয় যে, তারা লুটপাট করবেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আক্ষেপ করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে নিয়ে ছেড়েছে। আমি বলি, বিএনপি এখন যা করছে (ক্ষমতায় যাবার আগে) তাতে এ দেশের অবস্থা জাহেলিয়াত থেকে নিকৃষ্ট অবস্থায় চলে যাবার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বা গ্রামে এখন মুরুব্বী বলতে কেউ নেই। আগে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান/মেম্বাররা সমাধান দিতে পারতেন। এখন তারাও নেই। মানুষ কোথায় যাবে। অনেকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ত্বরান্বিত করার কথা বলছেন। আমি গ্রামের অবস্থা যা দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে যে, ৩/৪ মাসের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন তথা ইউনিয়ন উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নির্বাচন সংস্কার কমিটি এ সুপারিশ করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু দেশে বৃহত্তম দল বিএনপি এতে রাজি হচ্ছে না। আমার অনুসন্ধানে যে কারণ আমি দেখেছি সেটা হচ্ছে এ মুহূর্তে স্থানীয় নির্বাচন হলে এক একটা আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে কমপক্ষে ১০/১২ জন নেতানেত্রী প্রার্থী হয়ে যেতে পারেন। এতে তাদের নিজেদের মধ্যে যে হানাহানি হবে তা সামাল দেয়ার অবস্থা তাদের নেই। এটা জাতীয় নির্বাচনেও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আমার উপজেলার বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা আছেন। তিনি একজন শিল্পপতিও বটে। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি একাধিকবার চেষ্টা করেছি। তার তিন প্রতিষ্ঠানের তিন পিএসকে অনুরোধ করেছি সংযোগ দেয়ার জন্য, কিন্তু পাইনি। তিনি নিজে টেলিফোন ধরেন না এটা তার উন্মাসিকতা না আত্মম্ভরিতা আমি জানি না। কিন্তু তার দল যে দেশকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়টি উপলব্ধি করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তার আছে। জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সাথে তারা যেভাবে আচরণ করছেন তা না হয় বাদই দিলাম। তাদের অনক ভালো লোক আছেন তারা এখন কোথায়? একজন মনীষী বলেছেন, People Suffer not become of the violence of the criminals but become of the silence of the good people. অর্থাৎ মানুষের দুর্ভোগের কারণ অপরাধীদের হিংস্র আচরণ নয় বরং ভালো মানুষদের নীরবতা। কথাটা বাংলাদেশের বেলায় শতভাগ সত্য বলে আমার বিশ্বাস।