কলাম
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার কেমন বার্তা দিলেন? বর্তমান সভ্যতার ‘দাম্ভিক’ শাসকরা সরল ও স্বাভাবিক চিন্তার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। গরল ভাবনায় তারা পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছেন। ফলে আমাদের ধরিত্রীতে এখন শান্তি-স্বস্তি ও মানবিক বিকাশের কোনো বাতাবরণ নেই। দাম্ভিক শাসকদের দাবানলে সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে।
Printed Edition
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা? আমাদের চারপাশটা কেমন? দৃষ্টিকে প্রসারিত করে আরো দূরে তাকানো যায়। তবে দূরে তাকিয়েও আশাবাদী হবার মত তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের প্রিয় যে ধরিত্রী, যে বিশ্বব্যবস্থা তাকে ঘিরে রেখেছে, সেটা কেমন বিশ্বব্যবস্থা? বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মারণাস্ত্রভিত্তিক যে সভ্যতা, তা নিয়ে গর্ব করার মত কিছু আছে কি? তবে কেউ কেউ তো অহংকারও করছেন সভ্যতার দাম্ভিক শাসকরা মানবসম্মত বিশ্বব্যবস্থা গড়তে সক্ষম না হলেও একটা কাজ হয়তো তারা করে ফেলতে পারবেন-আর সেটা হলো আর একটা মহাযুদ্ধ, আমি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কার কথা বলছি। পরাশক্তির দেশগুলোতেও এক ধরনের নির্বাচন হয়, তবে যারা নির্বাচিত হন, সেই ‘মহানায়করা’ বিশ্বকে কেমন বার্তা দেন। না, সেখানে শান্তি ও স্বস্তির কোনো বার্তা নেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার কেমন বার্তা দিলেন? বর্তমান সভ্যতার ‘দাম্ভিক’ শাসকরা সরল ও স্বাভাবিক চিন্তার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। গরল ভাবনায় তারা পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছেন। ফলে আমাদের ধরিত্রীতে এখন শান্তি-স্বস্তি ও মানবিক বিকাশের কোনো বাতাবরণ নেই। দাম্ভিক শাসকদের দাবানলে সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে। মানববসতি গাজায় যেভাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালানো হলো, তাতে কি অভিশাপের কোনো কৃষ্ণ-কুন্ডলি তৈরি হয়নি? সে অভিশাপে এ সভ্যতা টিকে থাকবে তো? দাম্ভিক শাসকদের ভ্রষ্ট-ব্যবস্থাপনায় ধরিত্রীর ক্ষতিও কম হয়নি।
জলবায়ু সংকটে ধুঁকছে পৃথিবী। কার্বনে ভরে গেছে আমাদের আকাশ। জীববৈচিত্র্যেও অশনি সংকেত। মানুষকে নানাভাবে বোঝানো যায়, ধমক দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতির সাথে তা চলে না। সাম্প্রতিককালের ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, ভূমিকম্প কিংবা দাবানল আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? লসঅ্যাঞ্জেলেসে দাবানলের ধ্বংসযজ্ঞ আমেরিকা সহজে ভুলতে পারবে কি? বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মার্কিন সমরশক্তি দাবানলের মোকাবিলায় একেবারে অসহায় ছিল। একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। তাই বলতে হয়, প্রকৃতিকে সমীহ করতে কেউ যেন ভুল না করে। আর চিন্তকদের কেউ কেউ তো বলেন, স্রষ্টার অনুমোদন ছাড়া প্রকৃতি তার কর্মসম্পাদন করে না। সে এক রহস্যময় জগৎ। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় বস্তুবাদী মানুষের দৌড়তো দৃশ্যজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অদৃশ্যজগৎ সম্পর্কে তারা একেবারেই অজ্ঞ। এ জগতের কথা জানতে হলে তো নবী-রাসূলদের জানতে হবে, মানতে হবে। তাদের মান্য না করে, খন্ডজ্ঞান নিয়ে দাম্ভিক শাসকরা কিভাবে পৃথিবী শাসন করবেন, কিভাবে সংকটের সমাধান করবেন। পৃথিবীতে এখন সংকটের সংখ্যা কমছে, না বাড়ছে? শাসক মহাশয়রা তো এক একজন ধ্বংসের কারিগর।
বিশ্বসভ্যতা বলি, বিশ্বব্যবস্থা বলি-তার একটা অভিঘাত তো আছেই। বড় দেশগুলোর প্রভাব এতোটাই বেশি যে, সুদূর আমেরিকা থেকে একজন প্রেসিডেন্ট ‘ব্রেকফাস্টের’ দাওয়াত দিলে সবাই সহস্র মাইল দূর থেকে হুড়মুড় করে হাজির হয়ে যান। এটা তো ললিপপের মতো উদাহরণ। মসনদ ও হুমকি-ধমকির কথা এখানে নাই বা বললাম। পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির প্রতাপের কথা এখন শিশুরাও জানে। গাজায় শিশুদের স্কুল ও তাঁবুতে বোমা বর্ষণের দৃশ্য দেখে শুধু হতবিহ্বলই হয় না, ঘৃণাও প্রকাশ করে এখন শিশুরা। তাইতো ইসরাইলী ট্যাঙ্কের হৃৎপিন্ডে পাথর ছুঁড়ে ওরা প্রতিবাদ জানায়। ধ্বংসলীলা দেখতে দেখতে দাম্ভিক শাসকদের ওরা এখন ‘দানব’ হিসেবেই বিবেচনা করে। আঞ্চলিক নেতারাও এখন অসুর হয়ে উঠছেন। সবাই ধ্বংসের কারিগর। দেশপ্রেমিক নাগরিক কখনো স্বদেশের ধ্বংস চায় না। তাইতো ভারতের তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমে এসেছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রক্তের দামে তারা অর্জন করেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন তো হলো, কিন্তু আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি কোন পাটাতনে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন ও তার সাথে আন্দোলনে যুক্ত সংগ্রামীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে ইয়ামিন হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশের এমন প্রতিবেদনে গভীর বিস্ময় প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চরম পক্ষপাতদুষ্ট এ প্রতিবেদন অগ্রহণযোগ্য। আর শহীদ ইয়ামিনের প্রতি পুলিশের এমন আচরণকে ‘ভয়ঙ্কর বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ’ বলে প্রতিবেদন দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগও। উল্লেখ্য, তথ্য-উপাত্ত ও ভিডিও ক্লিপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাভারে প্রথম শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। তিনি মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অথচ এমন একজন সংগ্রামী ছাত্রকে পুলিশের প্রতিবেদনে ‘সন্ত্রাসী’ বানাবার আয়োজন করা হয়েছিল। আরও খবর আছে। বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অংকের আর্থিক দুর্নীতি করেছেন তুহিন রসুল। বার্লিনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়ার গোপন চিঠি এবং টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানে তুহিন রসুলের দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এরপরও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে উপসচিব পদে বহাল আছেন তিনি। উল্লেখ্য, কাজী তুহিন রসুল শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার প্রথম রায়দানকারী বিচারক কাজী গোলাম রাসুলের মেয়ে। এ পরিচয়কে পুঁজি করে তুহিন রসুল বার্লিনে বাংলাদেশ মিশনে ১০ বছরের বেশি সময় চাকরি করার পাশাপাশি বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে গেছেন।
তার দুর্নীতির বিষযটি জানাজানি হওয়ার পর ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট জারি করা এক আদেশে তাকে বার্লিনে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ঢাকায় প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হয়। শুধু তাই নয়, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় ১০ কাঠার একটি সরকারি প্লটও বাগিয়ে নিতে পেরেছেন তিনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার অনুসারীদের ‘গুনের’ অভাব নেই। তাদের একজন সৈয়দা জাহিদা সুলতানা রত্না । পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের আমলে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান রত্না। তিনি ছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহারে অভ্যস্ত। আপনজনদের ওপর অত্যাচার চালাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে করেছেন ঘরছাড়া; সম্পদও করেছেন আত্মসাৎ। তার অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর রত্নাই এখন পীরের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। উদ্দেশ্য, নিজেকে রক্ষা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির রেখে যাওয়া সব সম্পদ আত্মসাৎ করা। আসলে কিছু মানুষের কর্মের বয়ান আমার উদ্দেশ্য নয়। শেখ হাসিনার ছোহবত কত মারাত্মক, সেটাই উপলব্ধির বিষয়। হোন তিনি পুলিশ, দূতাবাস কর্মকর্তা কিংবা আইনজীবীÑ আপন অবস্থান বদলে তিনি হয়ে যেতে পারেন ভয়ানক কিছু, এমন কি পীরও। আর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সাথে তার যে নিষ্ঠুর আচরণ, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। গুম, ফাঁসি, হত্যার চেয়ে নিষ্ঠুর কাণ্ড আর কি হতে পারে?
ফ্যাসিস্টদের কোনো নৈতিক মূল্যবোধ থাকে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাঁরা যেকোনো কিছু করতে পারে। আর পতন ঘটলেও তাঁরা আত্মসমালোচনা কিংবা আত্মসংশোধনের পথে হাঁটে না; বরং প্রতিশোধ স্পৃহায় ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় মগ্ন হয় তারা। অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ তারা ব্যয় করে দেশে এবং বিদেশে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি ভালোভাবেই জানে। দেশের রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারণকেও ফ্যাসিস্ট এবং তাদের দোসরদের অপতৎপরতা উপলব্ধি করতে হবে। এখন দেশে দাবি-দাওয়ার নানা ফিরিস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত পনের বছরে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের অনুগতরা দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে বিদেশে। এতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে এবং দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের। মানুষের সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু পনের বছরের দুঃশাসন ও দুর্ভোগের সমাধান কি মাত্র ছয় মাসে সম্ভব? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ তো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে সংস্কার ও নির্বাচনের পথে হাঁটা। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই যেভাবে সড়ক অবরোধ করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে দাবি দাওয়া আদায়ের নিষ্ঠুর প্রদর্শনী চলছে, তাতে অনেকেরই অন্তর্গত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত সাত কলেজের আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে হয়। তাদের দাবি মেনে তাদের জন্য নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। এখন আবার তিতুমীর কলেজের কিছু ছাত্র দাবি করে বসলো, শুধু তাদের জন্যই দিতে হবে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়?
একটি পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়, তিতুমীর কলেজকে কেন্দ্র করে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে তিন নেতা, যাদের সম্পর্ক পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে। আসলে নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখন গর্ত থেকে গলা বের করার চেষ্টা করছে। বিষয়টি কি গণঅভ্যুত্থানের সাথে জড়িত রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন? উপলব্ধি করতে পারলে তো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বোলচাল এমন হতো না। অনেকেই এখন গণঅভ্যুত্থানে অবদানের ফিরিস্তি তুলে ধরে নিজেদের বড় করে দেখতে চাইছেন। ব্লেমগেমের তৎপরতাও শুরু করে দিয়েছেন। দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মুখে কালান্তরের এ সময়ে পুরানো মেধাবিহীন রাজনীতির এ কেমন প্রদর্শনী? গণঅভ্যুত্থানের সফলতায় দলীয় ঢেকুর না তুলে ঐক্যচেতনায় সাফল্য ধরে রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টাই তো এখন সময়ের দাবি। ইতিহাসের চোখ এখন সবার দিকে। দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে সবাইকে। কিন্তু প্রস্তুতির ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্পষ্টভাবেই। এ কারণেই হয়তো গণমাধ্যমে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী।