DailySangram-Logo-en-H90

কলাম

রোজায় পণ্যের দাম বাড়ে কেন

রমজান শুধু সংযমের মাস নয়; আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার মাস। মহান আল্লাহতায়ালার অতুলনীয় নেয়ামত লাভের প্রত্যাশায় গোটা মুসলিম মিল্লাতের মানুষেরা এ মাসের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে। রমজান সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত তিনি

Printed Edition

অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন

রমজান শুধু সংযমের মাস নয়; আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার মাস। মহান আল্লাহতায়ালার অতুলনীয় নেয়ামত লাভের প্রত্যাশায় গোটা মুসলিম মিল্লাতের মানুষেরা এ মাসের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে। রমজান সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমল দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, কিন্তু রোজা; রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। কারণ সে আমারই জন্য তার কামাচার এবং পানাহার বর্জন করে। রোজা পালনকারী ব্যক্তির জন্য খুশির বিষয় দুটি। একটি খুশি ইফতারের সময়, আরেকটি খুশি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। তার মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক উৎকৃষ্ট। (মুসলীম-১১৫১) এ মাস অন্যান মাসের চেয়ে উত্তম। অথচ সমাজের কিছু মানুষ রমজান আসার আগেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়ে কিভাবে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে পকেট ভারী করা যায়। কিভাবে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে ভোক্তাদের রক্ত শুষে নেয়া যায়। অথচ এটা ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলাম মজুতদারী, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্যাদির ব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ ধরনের কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এমন করে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। এরা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সে মহাদিবসে যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৬)

আমাদের দেশে প্রতিবছর রোজার মাস সামনে রেখে কিছু ব্যবসায়ী ব্যবসায়িক ফাঁদ পেতে সাহরি ও ইফতারসামগ্রীর দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাজারে পণ্যের সংকট না থাকলেও কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে। সম্প্রতি খাদ্য উপদেষ্টা রমজানে খাদ্যপণ্য সুলভমূল্যে এবং বিনামূল্যে বিতরণ কার্যক্রম সুশঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরোও জানান রোজার মাসে প্রায় ৭ লাখ টন খাদ্যপণ্য বিতরণ করা হবে। এছাড়া টিসিবির মাধ্যমে আরও ৫০ হাজার টন করে দুই মাসে এক লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে। ওমমএসের মাধ্যমে ৫০ হাজার টন করে আরও এক লাখ টন বিতরণ করা হবে। (সূত্র ঃ বাসস, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির অন্তর্নিহিত একটি বড় কারণ সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট যুগ যুগ ধরে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকার পরিবর্তন হলেও সিন্ডিকেট পরিবর্তন হয়নি। ফলে দেশের অধিকাংশ ব্যবসা দুষ্ট সিন্ডিকেটের নিকট জিম্মি হয়ে পড়ে। নিকট অতীতে লবণ কেলেঙ্কারি, ডিম কেলেঙ্কারি, আলু কেলেঙ্কারি, পেঁয়াজ কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটলেও কারও বিচার হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। ফলে ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পরও বাজার সিন্ডিকেন্ট বন্ধ হয়নি, যার প্রমাণ বাজার থেকে সয়াবিল তেল উধাও। হাসিনা সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে সর্বত্র দুর্নীতির চাষাবাদ করেছিল। ফলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। এখন তো ফ্যাসিস্ট নেই তাহলে কেন রমজানের আগে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যে সব ব্যবসায়ী দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে রোজাদারদের কষ্ট দিচ্ছে সে সব মুনাফাখোরদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। যেন আর কোনো মুনাফাখোর তৈরি না হয়।

কোনো ধরনের যৌক্তিকতা ছাড়াই প্রতিবছর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য রমজান আসলেই হু হু করে বাড়ে। কেন বাড়ে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় তারা মানবিক অনুভূতিও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে নিত্যপণের দাম হু হু করে বাড়ছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কয়দিন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মানুষের চেহারায় স্বস্তির ছাপ ছিল। মানুষ নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে আগের স্বরূপ আবার ফিরে এসেছে। সিন্ডিকেটের থাবা আবার বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ফলে নিত্যপণ্যের গায়ে হাত দেয়া যাচ্ছে না। ধরলেই হাত পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিনষ্ট হচ্ছে ঘরের শান্তি ও ভালোবাসা। চাহিদামত দ্রব্য মানুষ ক্রয় করতে পারছে না। অনেকে বাজেট কাটছাঁট করেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কেউ কেউ কষ্টের জমানো সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাচ্ছে। কিছু সংখ্যক মানুষ ব্যতিত অধিকাংশ মানুষ উভয় সংকটে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা না পারছে টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটতে, না পারছে কারও কাছে হাত পাততে। ফলে তাদের জীবনে আর্থিক যন্ত্রণা কিছুতেই কমছে না।

ইসলামে ব্যবসাকে শুধু জীবিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না; বরং আমানতদার হিসেবে ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। এটা এমন একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম, যা মানব কল্যাণবোধের ধারণায় উজ্জীবিত, স্বীকৃত ও পরিগণিত। মানব সত্বাকে রক্ষা, সমাজের কল্যাণবোধ ব্যবসার মৌলনীতি। শুধুমাত্র লাভের অংশকে স্ফীত করাকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অপর দিকে রসুল (স.) এর বক্তব্য ‘সর্বোত্তম উপার্জন হচ্ছে নিষ্ঠাপূর্ণ বেচাকেনা।’ একইসাথে মজুতদারীর ব্যাপারে রয়েছে কঠোর সতর্কবাণী- ‘যে মূল্যবৃদ্ধির জন্য ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, সে আল্লাহর হেফাজত থেকে বেরিয়ে যাবে।’ ‘সৎ ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়, পণ্য মজুতকারী হয় অভিশপ্ত’ এবং ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়’ প্রভৃতি সতর্কবাণীর মাধ্যমে ব্যবসায়ে মজুতদারী, ভেজাল, ক্রেতাকে প্রতারিত করার বিরুদ্ধে নবী (স.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন।

আমাদের দেশের মানুষের চাহিদা খুব বেশি নয়; তারা সাদামাটা জীবন ধারণ করতে চায়। তারা চাল, ডাল, আলু ও তরিতরকারি সুলভমূল্যে ক্রয় করতে পারলেই খুশি। তাঁরা প্রতিদিন গরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে চায় না; বরং আলু ভর্তা আর ডাল পেলেই মহাখুশি। রোজার মাসকে রহমতের মাস বলা হয়। অথচ এ রহমতের মাসে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অস্থির করে তুলছে। তারা অধিক মুনাফার আশায় পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে সাহরি ও ইফতারের যে আইটেমগুলো আছে সেগুলো সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে দেয়। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে ব্যবসায়ীরা রোজার মাসে পণ্যদ্রব্যের উপর বিশেষ ছাড় দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে রোজার মাসে বাড়তি দামের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তারা অর্থের লোভে ভুলে যান নীতি নৈতিকত, ভুলে যান মানবতা ও মানবিকতা, ভুলে যান ধর্মের কথা। শুধু অর্থের পেছনে ছুটছেন তো ছুটছেন। পণ্যের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়বে তা তারা চিন্তাও করে না। তাদের দরকার শুধু অর্থ আর অর্থ। কে কত বেশি দাম বাড়াতে পারে সে প্রতিযোগিতা হয়। শুধু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকলে কথা ছিল। কিন্তু তাঁর সাথে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। রোজার মাসে রোজাদাররা যেন নির্বিঘ্নে রোজা রাখতে পারে সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বাজার মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ করা। যেন রোজার মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম মানুষের নাগালের ভেতর থাকে।