DailySangram-Logo-en-H90

কলাম

সুদের বিস্তার রোধে কর্জে হাসানার ভূমিকা

ইসলামী শরীয়াহর প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন। মানব জীবনের অন্যতম একটি বিষয় হলো-লেনদেন। সুতরাং লেনদেনের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে শরীয়াহ পরিপালন করলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদে যেমন বরকত হবে তেমনি সমাজের তথা দেশের সম্পদের উৎকর্ষ সাধিত হবে।

Printed Edition

॥ কামরুন নাহার আইরিন ॥

ইসলামী শরীয়াহর প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন। মানব জীবনের অন্যতম একটি বিষয় হলো-লেনদেন। সুতরাং লেনদেনের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে শরীয়াহ পরিপালন করলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদে যেমন বরকত হবে তেমনি সমাজের তথা দেশের সম্পদের উৎকর্ষ সাধিত হবে।

সম্পদের ব্যাপারে শরীয়াহর দৃষ্টিভঙ্গি : আল্লাহতায়ালা সম্পদকে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব ও অগ্রযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করে বলেছেন, “আর যে সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের জীবনযাত্রার অবলম্বন করেছেন, তা অর্বাচীনদের হাতে তুলে দিও না। বরং তা থেকে তাদেরকে খাওয়াও, পরাও এবং তাদেরকে সান্ত¡নার বানী শোনাও।” (সূরা নিসা, আয়াত ৫)

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- হজ্ব ও যাকাত, যা সম্পদের সাথে সম্পর্কিত। এসব মৌলিক এবাদতগুলো কেবল সম্পদশালী লোকের পক্ষেই পালন করা সম্ভব।

সম্পদ উপার্জনের গুরুত্ব বুঝা যায় কুরআনের এ আয়াত থেকে, “যখন সালাত আদায় করা হয়ে যায়, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তথা রিজিক থেকে অনুসন্ধান করো যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আল জুমুআ-১০)

ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন-সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথী হবেন। (জামেউত তিরমিজি)

সমাজে সুদের বিস্তার ও ভয়াবহতা : বাংলাদেশে নানা কারণে একদল সুদ ব্যবসায়ী জনগণকে ব্যাপকভাবে শোষণ করছে। দরিদ্র জনগণের অনেক সময় সামান্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে কিন্তু এটি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অনেকের চিকিৎসা খরচের জন্য, ছেলে মেয়ের বিয়ের জন্য, বাড়ির সংস্কার অথবা ছোট একটি ঘর নির্মাণের জন্য সামান্য পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব প্রয়োজন মেটানোর জন্য সামাজিক কর্জের কোন ব্যবস্থা নেই। এসব প্রয়োজনে বিনা সুদে কর্জ দিয়ে সাহায্য করবে, এরকম কোন ব্যবস্থা দেখা যায় না। বিদ্যমান এই সুযোগে সমাজে কিছু উচ্চ সুদের ঋণ দেওয়া ব্যক্তি পেশায় নেমেছে, তারা অত্যন্ত উচ্চ হারে গরিব জনসাধারণকে এবং নি¤œ সাধারণ ব্যক্তিদের ঋণ দিয়ে থাকে। তাদের সুদের হার খুব বেশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ পর্যন্ত চলে যায়, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কেউ যদি ১০ হাজার টাকা ঋণ নেয় তাহলে তাকে সর্বমোট ২২ হাজার টাকা বা তার চেয়ে বেশিও পরিশোধ করতে হয়। এ অবস্থায় নি¤œ আয়ের মানুষ ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন হয়। যখন ঋণ পরিশোধের সময় হয় তখন তাদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে তারা নিঃস্ব হয়ে যায়, অনেকে পালিয়ে যায়, এমনকি অনেকে আত্মহত্যা করে বলে পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়। এর বিরুদ্ধে সরকার এবং পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, অনেক মুসলিম নামধারী ব্যক্তি এই কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদেরকে পাওয়া যাবে শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে, প্রতিটি গ্রামে।

কর্জে হাসানার ভূমিকা : কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে কর্জে হাসানার কথা বলা হয়েছে। কর্জে হাসানার অর্থ হচ্ছে- এমন কর্জ বা ঋণ যেটি সময়মত পরিশোধ করা হবে কিন্তু কোন অতিরিক্ত অথবা বেনিফিট নিতে পারবেন না। এটির উদ্দেশ্য হল সমাজের একটি বিশেষ প্রয়োজন পূরণ করা। সেটি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরেও নানা কারণে মানুষের অল্প পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতে পারে, এসময় ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না কিন্তু সম্ভাবনা থাকে যে পরে হবে এবং সে অর্থ দিয়ে কর্জ বা ঋণ পরিশোধ করা যাবে। সুদকে ইসলাম হারাম করেছে; ফলে কোন ব্যক্তির পক্ষে সুদী অর্থনীতিতে জড়ানো উচিত নয়। মানুষ সাময়িকভাবে কর্জ বা ঋণ নিয়ে পরবর্তীতে তা বিনা সুদে পরিশোধ করে দিতে পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা দিতে প্রস্তুত, তাহলে আল্লাহ তাকে কয়েকগুণ বেশি ফিরিয়ে দিবেন, হ্রাস বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত আর তাঁরই নিকট তোমাদের ফিরে যেতে হবে। (সূরা আল বাকারা, ২৪৫)

“আল্লাহ বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে বার জন সর্দার নিযুক্ত করেছিলাম। আল্লাহ বলে দিলেন : আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। যদি তোমরা নামায প্রতিষ্ঠিত কর, যাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাঁদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দিব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। (সূরা আল মায়েদা, ১২)

কর্জে হাসানা দেয়ার ফজিলত : ঋণ দেয়া একটি ইবাদত। পার্থিব উপকারিতা দৃশ্যমান না হলেও অপার্থিব উপকারিতা উপলব্ধি ও বিশ্বাস করতে হবে। লাভের চিন্তা না করে ঋণ দিতে হবে।

“শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে, যে মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করবে। (আল হাদিস)

কর্জে হাসানার মাধ্যমে মানব কল্যাণ করা যায়। আল্লাহ বলেছেন, তুমি মানুষকে ঋণ দিলে আল্লাহকে ঋণ দেয়া হয় এবং আমি তোমাদের অনেক গুণ বৃদ্ধি করে তা ফেরত দিবো। বাড়িয়ে দান করব ও এই দাতার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। ইসলাম এ বিষয়ে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখায়। এনজিও বা সুদী কারবারীর মত শোষণ করে না। ঋণগ্রহীতা অসচ্ছল হলে কিছুটা সময় বাড়িয়ে দিতে এবং কিছু অংশ মাফ করে দিতে বলা হয়েছে। তা ঋণদাতার জন্য কল্যাণকর। “কাউকে দুইবার কর্জে হাসানা দিলে, তা সাদাকা হিসেবে স্থায়ী হবে। (ইবনে মাজাহ, ১৯৮৭)

হাদিসে এসেছে-“বান্দার চাহিদা পূরণ করা যেন আল্লাহর চাহিদা পূরণ করার মত, বান্দাকে ঋণ দিলে যেন আল্লাহকে ঋণ দেয়ার মত, বান্দাকে খাদ্য দিলে যেন আল্লাহকে খাদ্য দেয়ার মত মর্যাদা।”

মেরাজে গিয়ে রাসুল (সা.) দেখলেন জান্নাতের দরজায় লেখা আছে- “সাদাকার সওয়াব দশ গুণ এবং কর্জে হাসানার সওয়াব ১৮ গুণ। নবীজী (সা.) অবাক হয়ে গেলেন এবং জিবরাঈল (আ.) জিজ্ঞেস করলেন এর কারণ কী? তিনি বললেন- যিনি সাদাকা চান তার আরো চাওয়ার জায়গা আছে আর কর্জ তিনি চান যার আর কোন উপায় থাকে না চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে। (আত তারগীব, ৩৩৫)

দেনাদারের দায়িত্ব : দেনাদারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকলেও ঋণদাতার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই খারাপ আচরণ করা, যোগাযোগ বন্ধ করা, ফোন রিসিভ না করা, ফোন নাম্বার পরিবর্তন ইত্যাদি করা যাবে না।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থের মূল্য বেড়ে গেলে দেনাদারের উচিত কিছু বাড়িয়ে পরিশোধ করা, এটা সুন্নাহ। পাওনাদারের হক সংরক্ষণ এর ব্যাপারে আল কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াত, সূরা বাকারার ২৮২ নাম্বার আয়াত উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা হয়েছে “লেনদেনটি লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে, কম বেশি লেখা যাবে না এবং সাক্ষী রাখতে হবে। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের নিয়ত থাকলে ব্যবসায় বরকত হয়।

“আমল নির্ভর করে নিয়তের উপরে।” (সহীহ বুখারী)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, “ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে মানুষের অর্থ ঋণ নিলে, আল্লাহ তায়ালা তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে ব্যক্তি তা বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন। (সহীহ বুখারী)

ঋণ হলো হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ ব্যক্তির হক যা পাওনাদার মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না।

ঋণ পরিশোধকারী ব্যক্তি জান্নাতি হিসেবে কেয়ামতের দিন উঠবে। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, যে ব্যক্তির প্রাণ দেহ থেকে পৃথক হলো এমন অবস্থায় যে, সে তিনটি বিষয় থেকে মুক্ত, তাহলে সে জান্নাতি হবে-অহমিকা, আত্মসাৎ ও ঋণ। (ইবনে মাজাহ)

উত্তমভাবে ঋণ পরিশোধের মর্যাদা : আবু হুরায়রা বর্ণিত এক ব্যক্তি নবীকে ঋণ পরিশোধে তাগাদা দিলেন। সাহাবীরা রেগে গিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে চাইলে নবী বললেন, তাকে একটি উট দিয়ে দাও এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করবে। (বুখারী)

ঋণের উত্তম বিনিময় হল- তা পরিশোধ করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

আব্দুল্লাহ ইবনে বারিআ বর্ণিত, একবার নবী করিম (সা.) ৪০ হাজার দিরহাম ধার নিলেন। পরে পরিশোধের সময় বললেন- আল্লাহ তোমার ঘরে ও মালে বরকত দিন। ঋণের বিনিময় হচ্ছে এই, ঋণ গ্রহণকারী কৃতজ্ঞতা আদায় করবে এবং পরিশোধ করে দিবে (সুনানে নাসাই)

ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব : কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমরা বুঝতে পারলাম, ইসলামে কর্জে হাসানার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ এতবার কর্জে হাসানার বিষয়ে বলেছেন যে, এটা আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। আল্লাহকে ঋণ দেয়ার অর্থ হচ্ছে গরিব- দুঃখী, অভাবীদের, যাদের প্রয়োজন তাদেরকে ঋণ দেওয়া। এটা ইসলামিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা অনেকটা কমে গেছে। প্রত্যেক ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে কর্জে হাসানার ব্যবস্থা থাকলে সুদ ও শোষণের প্রচলন ধীরে ধীরে কমে যাবে। দারিদ্র্য ও অসুবিধা দূরীকরণে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উদ্যোগে “কর্জে হাসানা ফান্ড” থাকা প্রয়োজন। এ ফান্ড থেকে গরিব-দুঃখী ও অভাবীদের কর্জে হাসানা দিলে সমাজের একটি বড় অংশ সুদমুক্ত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : দাঈ ও ব্যাংক কর্মকর্তা।