কলাম
আগস্ট বিপ্লব ও বৈশ্বিক গণহত্যা
মূলত, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কদর্য মানসিকতা থেকেই রাজনীতিতে চরমপন্থার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
Printed Edition
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
মূলত, আইন ও সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কদর্য মানসিকতা থেকেই রাজনীতিতে চরমপন্থার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় বলে এ শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় এমন অনেক নজির পাওয়া যায়, যেখানে একনায়ক বা স্বৈরশাসকের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ব্যাপক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় ঠিক উল্টো। এসব একনায়করা সব সময় দাবি করে এসেছেন তারা যা কিছু করেছেন এসব সর্ব মানুষের কল্যাণে নিবেদিত।
ইতিহাসের সে নির্মমতার ধারাবাহিকতায় গত বছরের মধ্যভাগে আমাদের দেশেও ব্যাপক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা জুলাই গণহত্যা নামে সারাবিশ্বেই পরিচিতি পেয়েছে। মূলত, এ গণহত্যা ছিল ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। মূলত, গত জুন মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করলে জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে জোরদার রূপ লাভ করে। ১৫ জুলাই আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর উত্তেজনা বেড়ে যায়। পরবর্তী দিনগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সাথে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে অসংখ্য ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আগস্টের শুরুর দিকে সহিংসতার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। প্রাণহানির সংখ্যা দু’শ’ থেকে ছয়শ’ পর্যন্ত অনুমান করা হয় এবং আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। পরবর্তীতে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারে গিয়ে পৌঁছে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এ নির্মম গণহত্যা। এ অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০% চাকরির কোটা পুনর্বহাল করার মাধ্যমে। এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ কোটা সংস্কার করা হয়েছিল।
আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় এবং সারাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে। এর পাশাপাশি, আওয়ামী লীগের কিছু মন্ত্রী ও সদস্য দলের অঙ্গসংগঠনগুলো, যেমন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়। এসব ব্যবস্থার মধ্যে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগও ছিল। ফলে সারাদেশেই ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এসব হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে প্রায় ৪৬টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। কবরস্থানের কর্মীরা জানান যে, ১৯ জুলাই থেকে এ ধরনের দাফনের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তবে কবরস্থানের অফিসিয়াল রেকর্ডে এসব অজ্ঞাত ব্যক্তির কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। আগস্টে জানা যায় যে, নিহতদের ৭৮% প্রাণঘাতী গুলির আঘাতে মারা গেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত গণহত্যায় ৬৫০ জন নিহত হন। তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা ১,০০০-এর কাছাকাছি হতে পারে। মৃত্যুর সংখ্যার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ২৬৬ জন মারা গেছেন। তবে, প্রথম আলো জানায় যে, ১৬ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ৬২৪ জন মারা যান, যার মধ্যে ৩৫৪ জনের মৃত্যু শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে ঘটে। মোট মৃতের মধ্যে ৭০ জন শিশু ছিল। এছাড়া, কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে নিহতদের মধ্যে ১১৭ জন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) এবং ৮৭ জন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা একটি ভ্যানে মৃতদেহ জমা করছেন। রক্তমাখা মৃতদেহগুলো আংশিকভাবে চাদরে মোড়ানো ছিল এবং অস্ত্রধারী পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা সেগুলো ভ্যানগাড়িতে তুলছিলেন। ধারণা করা হয় ভিডিওটি সাভারের আশুলিয়া থানা সংলগ্ন এলাকার এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ৫ আগস্টের ঘটনা ছিল। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম দেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নথি অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালীন ১,৭০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ৯৮ জন মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, বেশ কয়েকটি মৃতদেহে গুলির ক্ষত ছিল, যেগুলো ময়নাতদন্তের আগে পরিবারের সদস্যরা জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল।
গত বছরেরর ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির বনভিত্তিক দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘দ্য মিরর এশিয়া’ একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করে যে, ১৬ জুলাই হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্র-বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়ার পর, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) দ্বারা প্রশিক্ষিত ৪০০ জন কর্মকর্তা শেখ হাসিনা এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের অনুরোধে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তারা কাশ্মীরের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে জড়িত ছিলেন এবং ২৮ জুলাই দিল্লিতে ফিরে যান।
একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু বাংলাদেশেই এমন গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি বরং বৈশ্বিক ইতিহাসে এ ধরনের আরো অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার ঘটনা জানা যায়। কিন্তু এসব গণহত্যার প্রতিভূদের নির্মম পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর বৈশ্বিক গণহত্যার ঘটনার উল্লেখ করা হলো-
১. উত্তর কোরিয়ার মানবতাবিরোধী আচরণ ও গণহত্যা (১৯৪৮- চলমান) : বিশ্বের সবচাইতে মানবতাবিরোধী ও স্বাধীনতা দমনাত্মক সরকার হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সরকার। দেশটিতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবিরোধের জের ধরে ২ লাখেরও বেশি মানুষকে এখন পর্যন্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৪৭ থেকে এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় একনায়কতন্ত্রের ফাঁদে গণহত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ৭-৩৫ লক্ষ মানুষ।
২. ইয়ং তুর্কির অটোম্যান হলোকাস্ট (১৯১৩- ১৯২২) : ১৯০৮ সালে তুরস্কে নতুন সরকার গঠন করা হলে একদল সংস্কারপন্থী লোক নিজেদেরকে ইয়ং তুর্কি বলে অভিহিত করে এবং সুলতান আব্দুল হামিদকে উৎখাত করে। নতুন এবং আধুনিকতার আড়ালে ইয়ং তুর্কিদের দ্বারা সংগঠিত অটোম্যান হলোকাস্ট মূলত কয়েকটি আলাদা আলাদা গণহত্যার সম্মিলিত রূপ। এগুলো হলো আর্মেনিয়ান গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ৮-১৫ লক্ষ), অ্যাসিরিয়ান গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ১.৫ লক্ষ ৩ লক্ষ), গ্রিক গণহত্যা (মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৯ হাজার-৭ লক্ষ ৫০ হাজার), এবং মাউন্ট লেবাননের চরম দুর্ভিক্ষ (মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ)। সব মিলিয়ে আনুমানিক প্রায় ১৫-২৫ লক্ষ মানুষ ইয়ং তুর্কিদের অটোম্যান হলোকাস্টের বলি হয়েছিলেন।
৩. খেমার রুজের কম্বোডিয়ান গণহত্যা (১৯৭৫-১৯৭৯) : কম্বোডিয়ার সরকার প্রধান পোল পটের অধীনে এ গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আনুমানিক ১৫ থেকে ৩০ লক্ষে। মার্ক্সবাদী নেতা পোল পট স্ট্যালিনিজম এবং মাওবাদী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। জোরপূর্বক শহুরে জনগণকে গ্রামে পাঠাবার বিনিময়ে কম্বোডিয়াকে এর মূল্য দিতে হয়েছিল চরমভাবে। কম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ক্ষুধা, নির্যাতন, দুর্ভিক্ষ, অপুষ্টির কারণে তারা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে কম্বোডিয়ার এ গণহত্যার প্রমাণস্বরূপ ২৩ হাজার ৭৪৫টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লক্ষ।
৪. মাদাগাস্কারে রানী প্রথম রানাভালোনার নৃশংসতা (১৮২৯-১৮৪২) : প্রথম রানাভালোনা মাদাগাস্কারের রানী হবার পর বৈদেশিক সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং জনগণকে বিনা পারিশ্রমিকে দিন রাত খাটাতেন। তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ফ্যানমপোয়ানা প্রথা, সামরিক নির্যাতন, অনৈতিক বিচার ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৯, এই ছয় বছরে মাদাগাস্কারের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষতে নেমে এসেছিল। অন্যদিকে মাদাগাস্কারের অংশ ইমরিনা রাজ্যেও রানাভালোনার নৃশংসতার কারণে আরো প্রায় ৬ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছিল।
৫. কঙ্গো ফ্রি স্টেট এবং কসাই রাজা লিওপোল্ডের হত্যাযজ্ঞ (১৮৮৫-১৯০৮) : কঙ্গো ফ্রি স্টেট তাদের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১৮৮৫ সালে কঙ্গোর লিজ নেয়ার জন্য বার্লিন কনফারেন্সে আবেদন করেন বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড। কঙ্গোর উন্নতির কথা বলে, তিনি তার নিজের দেশের চাইতে ৭৬ গুণ বড় কঙ্গোতে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে জোরপূর্বক রাবার চাষ করাতে শুরু করেন। বর্বর পাবলিক ফোর্সের মাধ্যমে কোনো শ্রমিকের ভুল দেখলেই তার অঙ্গচ্ছেদ করা হতো। এমনকি দেওয়া হতো মৃত্যুদণ্ডও। এভাবে কঙ্গোতে নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ১ কোটি শ্রমিক!
৬. হিরোহিতোর জাপানী যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট হলোকাস্ট (১৮৯৫-১৯৪৫) : দ্বিতীয় সাইনো-জাপানিজ সংঘাত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এটিকে এশিয়ান হলোকাস্ট নামে অভিহিত করে থাকেন। জাপানী যুদ্ধাপরাধের দরুন, আনুমানিক ৩০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৪০ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক এবং বন্দীকে যুদ্ধের জের ধরে হত্যা করা হয়েছিল।
৭. চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের গণহত্যা (১৯২৮-১৯৪৬) : ইতিহাসের সবচাইতে বড় গণহত্যার একটি নজির স্থাপনের জন্য চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারকে দায়ী করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রায় ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ গণহত্যার পেছনে চীনের এই জাতীয়তাবাদী সরকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। চীনা কম্যুনিস্ট এবং সাধারণ চাষিরা রাজনৈতিক নিগ্রহের শিকার হয়ে প্রায় ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই কর্মযজ্ঞ চলাকালে প্রায় ৪২ লক্ষ চীনা নাগরিক যুদ্ধে যাওয়ার আগেই ক্ষুধা এবং অসুখে মারা গিয়েছিল।
৮. হিটলারের অধীনে জার্মানির নাৎসি হলোকাস্ট (১৯৩৯-১৯৪৫) : মূলত, এটি ছিলো নাৎসি হলোকাস্ট। মূলত ইহুদি, পোলিশ, সমকামী, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, জিপসি, সার্বিয়ান জনগোষ্ঠী, ফ্রিম্যাসন, ইস্ট স্লেভস, জেহোভান সাক্ষী এবং যুদ্ধবন্দীরাই ছিল এই নাৎসি হত্যাযজ্ঞের প্রধান শিকার। জার্মান দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ইউরোপ, নাৎসি জার্মানি এবং জার্মান মিত্রবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সব অঞ্চলে এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। এ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য জার্মান নাৎসি বাহিনী কর্তৃক প্রায় ৪২,৫০০ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ব্যবহৃত হয়েছিল। এতে জীবন দিতে হয়েছিলো ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষকে!
৯. স্ট্যালিনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা (১৯২২-১৯৫৩) : স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিন তার শাসনামলে দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে, শ্রমশিবিরে নির্যাতন চালিয়ে, স্ট্যালিনবিরোধী এবং সমালোচকদের নির্বাসনে পাঠিয়ে, বিতাড়িত করে এবং এনকেভিডি বাহিনীর সাহায্যে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছিলেন। ইউএসএসআর পতনের পর পোস্ট আর্কাইভের হিসেব মতে প্রায় ৪০ লক্ষ থেকে ১ কোটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে স্ট্যালিনের স্বৈরশাসন।
১০. মাও সে তুং এবং চীনের দুর্ভিক্ষ (১৯৪৬-১৯৭৬) : চীনা গৃহযুদ্ধে, জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চায়না কম্যুনিস্ট পার্টির জয়ের নেতৃত্ব দেয়া মাও সে তুংয়ের সুখ্যাতি থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে। এ সময় গণহত্যার শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। চেয়ারম্যান মাওয়ের একরোখা নীতির কারণে চীনে দেখা দেয় মহাদুর্ভিক্ষ। মারা যায় আনুমানিক ৪ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। ভূমিসংস্কার নীতির কারণে মৃত্যুবরণ করে আনুমানিক আরো ৮ লক্ষ মানুষ। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে, ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি।
ইতিহাসের অনেক চাঞ্জল্যকর গণহত্যার ঘটনা ঘটলে আমাদের দেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ, শুধুমাত্র এক ব্যক্তির জিদ ও ক্ষমতা টিকে রাখার জন্য সারাদেশেই ব্যাপকভিত্তিক গণহত্যা চালানো হয়েছিলো। কিন্তু বিপ্লবোত্তর অপরাধীদের মধ্যে অনুসোচনা লক্ষ্য করা যায় নি বরং তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে নানাবিধ উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে নির্লজ্জভাবে নিপাপরাধ দাবি করে এসেছে। কিন্তু এতে হাটেহাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন (ওএইচসিএইচআর)। আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিভাগেরই মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
এতে আরো বলা হয়, তদানীন্তন সরকারের দলনপীড়নের মুখোমুখি হয়ে আরো হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছে এ অভ্যুত্থানে। এছাড়া পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে ও পঙ্গু হয়েছে।’ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের সাথে অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া প্রমাণগুলোর সমন্বয় করে ওএইচসিএইচআর-এর ওই প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তখন পদ্ধতিগত ও সংগঠিতভাবে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ হয়ে উঠেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর আরো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে ওএইচসিএইচআর। যা গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে আওয়ামী সরকার ও শেখ হাসিনার ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতহ্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্ব ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিষয়টি অভিনব না হলেও আগস্ট বিপ্লবকেন্দ্রিক গণহত্যা ইতিহাসে নজীরবিহীন বলতেই হবে। কারণ, এ গণহত্যা চালানো হয়েছিলো এক ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে রাখার জন্য। শুধু তাই নয় বরং ফ্যাসিবাদী শাসনকে পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করার জন্য সারাদেশেই ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম ও গুপ্তহত্যা ছিলো নিত্যদিনের। আর ‘আয়না ঘর’-এর নির্যাতন তো ইতিহাসের সকল নির্মমতাকে হার মানিয়েছিলো। তাই এসব অপরাধীর নুরেমবার্গের আদলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। অন্যথায় সভ্যতার ইতিহাস কোনভাবেই কলঙ্কমুক্ত হবে না।